রাণী রাসমণী, প্রিয়ংবদা, রমাবাঈ, লক্ষ্মীবাঈ, মাতাজী, সুশীলা, তারাবাঈ, ভগবতী দেবী, সরোজিনী নাইডু, শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, মাতঙ্গিনী হাজরা,

রাণী রাসমণী, প্রিয়ংবদা, রমাবাঈ, লক্ষ্মীবাঈ, মাতাজী, সুশীলা, তারাবাঈ, ভগবতী দেবী, সরোজিনী নাইডু, শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, মাতঙ্গিনী হাজরা,

Author:
Price:

Read more

রাণী রাসমণী

হাইকোর্টের মামলা।–
মামলাটি সপ্তমী পূজার নবপত্রিকা-স্নান সম্পর্কে। জানবাজার থেকে যে রাস্তাটি বরাবর বাবুঘাট পর্যন্ত গেছে, সেই পথের পাশে বাড়ী, কোন এক বড়-সাহেবের ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছিল। তিনি আইনের মারফতে জানিয়েছেন যে পথে অমনভাবে ঢাক ঢোল বাজিয়ে যাওয়া চলবে না। ফলে আরো বেশী উৎসাহে পরদিন পথে বেরিয়ে পড়লো অসংখ্য বাজনদার আর তারই সাথে এক শোভাযাত্রা। সেই  জন্য শান্তিভঙ্গের মামলা উঠেছে।
আসামী রাণী রাসমণি বললেন—এই রাস্তা তৈরী করে দিয়েছেল আমার স্বামী। আমার রাস্তায় আমি যা খুশি তাই করবো, সরকার যদি বাধা দেন, তাহলে রাস্তা আমি নষ্ট করে দেব।
বিচারে রাণীর পঞ্চাশ টাকা জরিমানা হোল।
রাণী হুকুম দিলেন—জানবাজার থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে লম্বা করে বেড়া বেঁধে দাও।
বেড়া বাঁধা হোল।
রাস্তা বন্ধ হোল।
সরকারী আদেশ জারী হোল – বেড়া তুলে নাও।
রাণী বললেন—রাস্তা আমার, যা খুশি করবো। দরকার মনে হলে গবর্মেন্ট রাস্তার দাম দিয়ে কিনে নিতে পারেন।
আবার কড়া হুকুম এলো।
ফল কিছুই হোল না।
তারপর এলো অনুরোধ। রাণীর জরিমানার পঞ্চাশ টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হোল, আর কথা রইল, সব পথেই পূজা-পার্বনের শোভাযাত্রা বেরুতে পারবে, তবে তার আগে কোম্পানীর কাছে আবেদন জানিয়ে একখানি ‘পাস’ নিতে হবে।
এবার রাণী বেড়া খুলে দিলেন, সরকারের সঙ্গে আপোষ হয়ে গেল।
একজন বিধবা মহিলার পক্ষে ইষ্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকার স্বীকার করিয়ে নেওয়া বড় কম দুঃসাহসের কথা নয়, রাণী রাসমণীর সে সাহস ছিল, এবং বার বার তিনি তার পরিচয় দিয়েছেন।
দক্ষিণেশ্বরের মন্দির এঁর অক্ষয় কীর্তি।
সাধারণ ঘরে জন্মে, পরে ইনি লাখ লাখ টাকার অধিকারিণী হন। মাহিষ্য জাতির মেয়ে, আজকালকার মত উচ্চশিক্ষা তিনি পান নি, কিন্তু ভারত-মহিলার যা বৈশিষ্ট তা তাঁর চরিত্রে পূর্ণমাত্রায় বিকাশ লাভ করেছিল জাতি বা শিক্ষার অপেক্ষা না রেখে। বাঙ্গালী বিধবার আদর্শ হয়ে আছেন তিনি আজও।


প্রিয়ংবদা

শিবরাম সার্বভৌম ছিলেন করিদপুরের নামকরা পণ্ডিত।
পণ্ডিত-মশাইয়ের একমাত্র মেয়ে প্রিয়ংবদা। অতবড় বণ্ডিতের মেয়ে কিন্তু পিতা তার শিক্ষার কোন ব্যবস্থা করলেন না। পণ্ডিত মশাই ভাবতেন মেয়েদের লেখা পড়া শেখার কি শাস্ত্র পড়ার কোন প্রয়োজন নেই।
মেয়েটি টোলের এক কোণে চুপ করে বসে থাকতো, আর শুনতো সংস্কৃত পাঠ। শ্লোকের সবটুকু তার কানে এসে বাজতো, যা শুনতো তাই সন্ধ্যার পর আবৃত্তি করতো নিজের মনে।
পণ্ডিতমশাই মেয়ের স্মৃতি-শক্তি দেখে মুগ্ধ হলেন, ঠিক করলেন—মেয়েও পড়বে তাঁর ছাত্রদের সাথে।
দেখতে দেখতে প্রিয়ংবদা কাব্য, অলঙ্কার, ব্যাকরণ, ন্যায় ও মীমাংসা শেষ করে ফেললেন। আর তারই সঙ্গে প্রকাশ পেল অপূর্ব কন্ঠ—সংগীত মাধুর্য।
নিজে সংস্কৃত শ্লোক রচনা করে তিনি গাইতেন, প্রতিদিন পূজার সময় তিনি একটি করে স্তব রচনা করতেন। তাছাড়া মার্কণ্ডেয় পূরাণে যে মাদালসা উপাখ্যান আছে, তার তিনি দার্শনিক ব্যাখ্যা লেখেন, মহাভারতের শান্তিপর্বের মোক্ষ ধর্মের একখানি টীকাও তিনি লেখেন।
এমন বিদূষী মেয়ের বিয়ে দেওয়া বড় সহজ কথা নয়। পণ্ডিতমশাইয়ের কোন পাত্রই মনে ধরে না। শেষে সার্বভৌম মশাই পাত্রের সন্ধানে কাশীতে গেলেন। সেখানে রঘুনাথ মিশ্র নামে এক কনৌজী ব্রাহ্মণের সঙ্গে প্রিয়ংবদার বিয়ে হোল। বিবাহের সময় সার্বভৌম মশাই মেয়ে-জামাইকে একখানি গাঁ যৌতুক দিলেন।
জামাই বললেন—জমিদারী করার ইচ্ছা থাকলে বাবার জমিদারীই দেখতে পারতাম, কিন্তু তা আমি চাই না, শাস্ত্র অধ্যয়নেই জীবন কাটানো আমার আদর্শ। গ্রামের দরকার নেই, সামান্য খেত-খামার হলেই চলবে, যাতে জীবনটা স্বচ্ছন্দে কেটে যায়।
নদীর ধারে ছোট কুটির বেঁধে স্বামী-স্ত্রী শাস্ত্র-পাঠে জীবন কাটাতে দিলেন। রান্না ও সংসারের কাজ শেষ করে স্ত্রী এসে বসতেন স্বামীর কাছে, হস্তাক্ষর ছিল ভালো, বড় বড় সংস্কৃত বই নকল করতে হোত বাংলায়। কিন্তু কোনদিন আলস্য দেখা দেয়নি, সংসারের প্রতিটি কাজ নিখুঁতভাবে করার জন্য দাসদাসী রাখার আগ্রহ প্রকাশ পায়নি কোন দিনই—এই ছিল ভারতের শিক্ষার আদর্শ।


রমাবাঈ
১৮৮৪ সালের কথা—
অবিরাম আন্দোলন চালাবার ফলে ইংরাজ-মেয়েরা সবেমাত্র উচ্চ শিক্ষার সুযোগকে সম্পূর্ণ করেছে। কুইন্‌স্‌ কলেজের আদর্শে একটির পর একটি মেয়ে-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে—সামারভিল কলেজ, লেডী মার্গারেট হল, গার্টন্‌ কলেজ, নিউন্‌হাম্‌ কলেজ...
চোথেলহাম কলেজ ছিল এগুলির মধ্যে সর্বপ্রধান।
বিলাতের নারী-শিক্ষার সেই উদয়কালে এক মারাঠী মেয়ে চোথেলহাম কলেজের অধ্যাপিকা নিযুক্ত হলেন।
যে জাতির গায়ে পরাধীনতার শিকল পরিয়ে অসভ্য ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন বলে অবজ্ঞা দেখানো হয় সেই জাতির মেয়ের পক্ষে এ বড় কম সম্মান নয়।
পণ্ডিতানী রমাবাঈ হয়েছিলেন এই সম্মানে সম্মানিতা।
পশ্চিমঘাটের এক অতি দরিদ্র ঘরে রমাবাঈয়ের জন্ম। পিতামাতার সঙ্গে তিনি ভারতের তীর্থে ঘুরে বেড়ান বছর ষোল পর্যন্ত, সেই সাথে চলে হিন্দুশাস্ত্র পড়া। সর্বশাস্ত্র শেষ করে ইনি স্ত্রী-শিক্ষা সম্বন্ধে সারা ভারতে আলোড়ন তোলেন। বিদ্যাসাগর মশাই এঁর প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন। সংস্কৃত কলেজে ও বিদ্যাসাগর কলেজে ইনি অনেক বক্তৃতা করেন। নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা এঁকে সরস্বতী উপাধি দেন।
তারপর পশ্চিমের শিক্ষাকে আয়ত্ব করার জন্য ইনি বিলাতে যান।
ইংলণ্ড থেকে যান আমেরিকায়। সেখানে ভারতের আদর্শ সম্পর্কে বহু বক্তৃতা করেন।
আজকের দিনে পৃথিবীর ওপিঠে গিয়ে ভারতের কথা বলা অনেক সহজ হয়েছে, কিন্তু ১৮৮৫ সালের প্রথম বক্ত্রীর পক্ষে বোধহয় এতো সহজ ছিল না। ভারতের জয়গান ইনিই বোধহয় প্রথম ধ্বনিত করেন মার্কিন উপকূলে।
এঁর আট বছর পরে ১৮৯৩ সালে স্বামীজী শিকাগো ধর্মসভায় বক্তৃতা করেন।

লক্ষ্মীবাঈ

রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যু হোল।
রাজার ছেলেমেয়ে ছিল না। সেই অজুহাতে ইংরাজরা ঝান্সী-রাজ্য দখল করে নিল।
ঝান্সীর রাণী প্রতিবাদ জানালেন—মেরা ঝান্সী দেংগা নেহি।
ইংরাজরা সে প্রতিবাদে কান দিল না।
রাণী লক্ষ্মীবাঈ উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিলাতে পাঠালেন কোট-অফ্‌-ডিরেকটারদের কাছে আপীল জানাবার জন্য।
কোন ফল হোল না।
রুদ্ধ আক্রোশ পুঞ্জীভূত হতে লাগলো রাণীর মনে।
এই সময় সিপাহী-বিদ্রোহের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠলো বাংলা থেকে বুন্দেলখণ্ড পর্যন্ত। লক্ষ্মীবাঈও তলোয়ার হাতে এগিয়ে এলেন সেই বিদ্রহীদলের সাথে—ইংরাজ কবল থেকে ঝান্সীকে মুক্ত করার বাসনায়। যুদ্ধ সুরু হোল।
একদিন দু’দিন নয়, মাসের পর মাস লক্ষ্মীবাঈ ও তাঁর বোন বিরাট ইংরাজ-বাহিনীকে রুখে দাঁড়ালেন ঝান্সীর দরজায়। সারা ভারতের দৃষ্টি পড়লো দু’বোনের উপর । সামান্য সামন্তরাজ্যের এক বিধবা রাণী শক্তিমান ইংরাজ-বাহিনীকে ঠেকিয়ে দিল কিসের শক্তিতে, বিস্মিত হিন্দুস্থান ভাবতে লাগলো সেই কথা।
যুদ্ধ লড়া হ’লে শেষ পর্যন্ত কি হোত বলা যায় না, কিন্তু তার আগেই ঘটলো বিপর্যয়।
রাণী ও তাঁর বোন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরছেন এমন সময় পিছন দিক থেকে গুলি ছুঁড়ে ইংরাজ সৈন্যরা তাঁদের দুজনকে নিহত করলো।
ঝান্সী রক্ষা করার কেউ আর রইল না।
ইংরাজ সেনা ঝান্সীতে প্রবেশ করলো।
ঝান্সী গেল, কিন্তু লক্ষ্মীবাঈয়ের শেষ নিঃশ্বাস জেগে রইল ভারতের আকাশে বাতাসে, সেই চিন্তাধারার উত্তরাধিকারের গৌরব আজও হিন্দুস্থানের রক্তের সাথে অনুরণিত।

মাতাজী
পূজার সময়—
তখন সার্বজনীন সুরু হয়নি। ছেলে-মেয়ের দল বাড়ী বাড়ী ঘুরে ঠাকুর দেখে বেড়ায়।
এক সন্ন্যাসীনীও বেরিয়েছেন ঠাকুর দেখতে।
সন্ন্যাসীর পথ চলতে বাধা নেই, এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ী তিনি চলেছেন পায়ে হেঁটে। তিনি যে রাজার মেয়ে পথে নেমেছেন, তার আভাস মেলে তাঁর দিব্যকান্তিতে।
সন্ন্যাসিনী ভাব-তন্ময় হয়ে চলেছেন, হঠাৎ কানে এসে বাজলো দুটি মেয়ের কথা ঃ
ঠাকুর মানে? মাটি ও খড় জড়ানো একটা মাটির পুতুল ভগবান হয়ে যাবে?
--ওর মাঝেই তো প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় বলে শুনি।
--বাজে কথা।
--তবে যে সাধুরা ওই পুতুলের সঙ্গেই কথা বলে—
ধ্যোৎ, যত বুজরুকী।
--পুজো, মন্ত্র—এসব বুজরুকী?
--মনের ভুল। নাহলে যে পুতুলগুলো নিয়ে আমার খেলি, সেগুলোও তো একদিন মানুষ হয়ে আমাদের সাথে কথা কইতে সুরু করতো।...
হিন্দুর মেয়ের এই কথা শুনে সন্ন্যাসিনী মনে বড় আঘাত পেলেন। রায়স্থানের রাজকন্যা তিনি। বিপুল বিলাস ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাস ও সাধনাকে তিনি শ্রেয় বলে গ্রহণ করেছেন। বছরের পর বছর দরে ঐকান্তিক একাগ্রতার ভিতর দিয়ে তিনি যে সত্যে এসে পৌঁছেছেন, এতটুকু মেয়েরা কিছু না জেনে, না বুঝে, তার নিন্দা সুরু করেছে। কেন এমন হোল?
‘মরর’ পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে সন্ন্যাসিনীর পরিচয় ছিল, কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—কেন এমন হোল?
নরেনবাবু বললেন—এর মূলে আছে খৃষ্টান মিশনারীরা। তারা মেয়েদের ইস্কুল খুলেছে এবং সেখানে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে এই সব বিষ ছড়াচ্ছে।
সন্ন্যাসী মনে মনে বড় ব্যথা পেলেন। হিন্দু-মেয়েদের হিন্দু-পদ্ধতিতে শিক্ষা দেবার আদর্শে তিনি এক ইস্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। সেখানে তিনি নিজে মেয়েদের পূজা অর্চনা শেখাতেন, স্তোত্রাদি পড়াতেন, নীতি শেখাতেন।
এই বিদ্যালয়টি নাম কি জান? মহাকালী পাঠশালা, প্রতিষ্ঠাত্রী মাতাজী। আমরণ মাতাজী এই পাঠশালাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের মানুষ হয়ে, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসিনী বাংলার মেয়েদের সুশিক্ষার উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করলেন। বাঙালী মারাঠির গণ্ডি তাঁর মনকে বেঁধে রাখতে পারেনি। হিন্দুস্থানের মানুষকে হিমালয় থেকে কুমারিকা পর্যন্ত তিনি এক জাতি বলে মনে করতেন, তিনি জানতেন একই আধ্যাত্মিক আদর্শের মধ্যে আমরা সবাই কেন্দ্রীভূত।

সুশীলা

বছর ত্রিশের আগের কথা।
বাঙ্গালীর সার্কাস।
হাজার হাজার দশক স্তব্ধ হয়ে বসে আছে রুদ্ধনিশ্বাসে। একটি মেয়েকে সকলের সামনে জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছে। একটি কাঠের বাক্‌সের মধ্যে মেয়েটিকে শুইয়ে একটা গর্তের মধ্যে রেখে মাটি চাপা দেওয়া হোল।
টিকটিক্‌ করে ঘড়ীর কাঁটা এগিয়ে চলে, দর্শকেরা স্তব্ধ হয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকে।
একে একে পাঁচটি মিনিট কেটে যায়।
পরক্ষণেই মাটির নীচে থেকে বাক্‌সটি তোলা হয়, বাক্‌স খুলতেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে উঠে। চোখ মুখ খুব লাল হয়ে উঠেছে, মুক্ত হাওয়ার গভীর ভাবে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে, সারা দেহটা বারেক কেঁপে উঠে, দর্শকের সামনে এসে দাঁড়ায়, দর্শকেরা উচ্ছ্বসিত হয়ে করতালি দিয়ে ওঠে।
খুচরো কয়েকটি খেলা দেখান হয়, কিন্তু ওই সমাধির পরে কোন খেলাই আর তেমন জমে না শেষে মেয়েটি আবার আসে।
তবে এবার আসে রীতিমত বাঘের খেলা দেখাতে।
তিনটে কেঁদো বাঘ-বাঘিনী দু’বার খ্যাক্‌ খ্যাঁক্‌ করে ওঠে, কিন্তু হাতের চাবুকটা নিয়ে সে যেই তার সামনে এগিয়ে যায়, চোখে চোখে তাকায়, অমনি বাঘিনীর মাথা হেঁট হয়ে আসে, পোষা বিড়ালের মত সে আবার খেলা দেখাতে সুরু করে। তিনটি বাঘ যেন তিনটি পোষ-মানা বিড়াল।
এই অসাধারণ মেয়েটি কে জান? বোসের সার্কাসের সুশীলা। বাঙ্গালী ঘরে এমন মেয়ে আজ অবধি আর একটিও জন্মায়নি।

তারাবাঈ

বেশী দিনের কথা নয়, বছর কুড়ি-পাঁচি হবে।
দক্ষিণ ভারতের একটি মেয়ে তখন সার্কাসে বিশেষ ভাবে নাম করেছে,--মেয়েদের গায়ে যে অমন জোর হয় তা বিশ্বাস করতে সহজে মন চায় না কিন্তু নিজের চোখতে তো আর অবিশ্বাস করা যায় না।
প্রায় উনিশ মণ একখানি পাথর পিঠের উপর চাপিয়ে দেওয়া হোল, দু’জন লোক দু’দিক থেকে সেইপাথররের উপর হাতুড়ি পিটতে সুরু করলো, তার পর মেয়েটি স্বচ্ছন্দে সেই পাথরখানি ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
তারপর একখানি গরুর গাড়ীতে আটজনকে বসিয়ে গাড়ীখানি টেনে নিয়ে যাওয়া হোল তার উরুর উপর দিয়ে।
সেই গাড়ীখানির সামনে একটি তীক্ষ্নধার লৌহফলা থাকতো, সেই ফলকের তীক্ষ্ন মুখটা কপালে লাগিয়ে সেই বোঝাই গাড়ী মেয়েটি ঠেলে নিয়ে এগিয়ে গেল পনেরো-কুড়িহাত। ফলকের তীক্ষ্ন সূচীমুখ বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারলো না, শুধু কপালে দু’এক ফোঁটা রক্ত দেখা দিল মাত্র।
তারপর সেই গুরুর গাড়ীতে আরো ক’জন লোককে বসিয়ে চুলে বেঁধে টেনে নিয়ে চললো মেয়েটি। গলার পেশীগুলো এতটুকু কঠিন হয়ে উঠলো না।
অমন যার গায়ে শক্তি তাকে দেখে কিন্তু তেমন কিছু মনে হয় না, দর্শকদের সামনে এসে যখন দাঁড়ায় তখন অসাধারণ কিছুই চোখে পড়ে না, কেন না তার চেয়েও কত লম্বা-চওড়া মেয়ে পথে-ঘাটে তাদের চোখে পড়েছে।
দর্শকরা চমকে যায়, যখন অমন বলিষ্ঠ মেয়েটি হালকা শোলার মত সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে একটা মাত্র তীক্ষ্ন বর্শার উপর। বর্শা-ফলকের মুখটি কোমরে বেল্‌টের উপর লাগিয়ে সোজা সমান্তরাল হয়ে যায় তার সারা দেহ, মাটির উপর ইংরাজী অক্ষর (T)এর মত।
খেলা দেখানো শেষ করে মেয়েটি দর্শকদের সামনে এসে দাঁড়ায়, সমবেতকে নমস্কার জানিয়ে এক দৌড়ে চলে যায় চোখের আড়ালে। মেয়েরা শক্তিমতী হতে পারে না, এবং যতই তারা ব্যায়াম করুক না কেন তারা পুরুষমানুষের চেয়ে দুর্বলা থাকবেই—একথা যাঁরা মনে করেন, তাঁরা বিস্ময়ে চেয়ে থাকেন শুধু।
ইনি কে জান? –ভারতের বিখ্যাত শক্তিমতী নারী তারাবাঈ। রীতিমত ব্যায়াম করলে যে মেয়েদের সৌন্দর্য নষ্ট হয় না, উপরন্তু পুরুষের মতই শক্তি ও স্বাস্থ লাভ করা যায় তা ইনি প্রত্যক্ষ করিয়েছেন নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে। এঁর আদর্শে অনুপ্রেরণা লাভ করলে আমাদের দেশের মেয়েরা সব রকম উপদ্রবের সামনে অনায়াসে আত্মরক্ষা করতে পারবেন একথা বলাই বাহুল্যমাত্র। রবীন্দ্র-সংগীত আর প্রাচ্যনৃত্যে পারদর্শিনী মেয়ের চেয়ে এই তারাবাঈয়ের মত মেয়েই আজ আমাদের দেশে বেশী দরকার হয়ে পড়েছে।

ভগবতী দেবী

শীতের সন্ধ্যা।–
গ্রামের বুকে ফাঁকা মঠের ঠাণ্ডা হাওয়া গাছের পাতায় পাতায় শির শির করে উঠছে। মানুষগুলোর যার যা আছে গায়ে জড়িয়ে আগুনের চারিপাশে গিয়ে বসেছে, বাড়ীর ছেলে মেয়েরা উনুনের পাশে বসে ঠক্‌ ঠক্‌ করছে। বুড়োরা মাথা নেড়ে বলছেন—এমন শীত নাকি অনেক দিন পড়েনি।
এক ভিখারিণী মেয়ে কোলে একটি ছেলে নিয়ে পথ চলছে। দুরন্ত মেঠো হাওয়া তার পরণের ছেঁড়া কাপরের ফালিগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে, সে কেঁপে উঠছে। তবু কোলের ছেলেটিকে গরম রাখার জন্য সেই ছেঁড়া কাপড়েই তাকে জড়িয়ে রাখছে বুকের মাঝে।
রায়দের চণ্ডীমণ্ডপের সামনে আগুন জ্বেলে অনেকে বসেছিল, মেয়েটি এসে দাঁড়ালো বললো—বাবারা কেউ আমায় একখানি ছেঁড়া কাপড় দেবেন?
সকলের দৃষ্টি এসে পড়লো তার মুখের উপর।
--ছেলেটার ঠণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছে। একখানা ছেঁড়া কাপড় পেলে....
রায়মশাই এবার কথা বললেন—আমরা সব ছাপোষা লোক বাছা, এই শীতের দিনে দু’খানা ছেঁড়া কাপড় পেলে একখানা কাঁথা করি। তুমি বরং একবার বাঁড়ুয্যেদের বাড়ী যাও, ওখানে হয়ত সুবিধে হতে পারে।
রায়মশাই বাড়ীটি দেখিয়ে দিলেন, ভিখারিণী দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখে পড়লো, ভিতরের দালানে একজন বর্ষিয়সী মহিলা বসে আছেন, ডাকলো মা।
--কে বাছা, ভিতরে এসো—
ভিখারিণী বাড়ীর ভিতরে গয়ে দাঁড়ালো, বললো—মা একখানি ছেঁড়া কাপড় দেবেন? ছেলেটার জ্বর...
মহিলাটি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন, বললেন—বলিস্‌ কি? এমন ঠাণ্ডায় ওই রোগা ছেলেটিকে খালি গায়ে...
--আমি ভিখারী মা—
--তা বলে ওই দুধের বাছা... এই নে, তাড়াতাড়ি ওর গায়ে ভালো করে চাপা দে—মহিলা নিজের গা থেকে নতুন লালা বালাপোষ খানি ভিখারিণীর হাতে তুলে দিলেন। ভিখারিণী এতটা আশা করেনি, তার চোখে জল এসে পড়লো।
ভিখারিণী চলে যাচ্ছিল, মহিলা তাকে ডেকে বললেন—আর শোন্‌ ছেলেটার জন্য একটু গরম দুধ নিয়ে যা—
ভিখারিণীকে বিদায় দিয়ে শীতবস্ত্রের অভাবে মহিলাটি সারারাত উনুনের পাশে বসে ঠক্‌ঠক্‌ করে কাঁপতে লাগলেন।
এমনি দয়াময়ী ছিলেন বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মা ভগবতী দেবী।

সরোজিনী নাইডু

আঠারো শো পঁচানব্বুই সাল। ষোলবছরের একটি বাঙ্গালী মেয়ে একাকী বিলাতে চলেছে আত্মীয় স্বজন কেউ সঙ্গে নেই, সঙ্গে আছেন শুধু পিতার এক বন্ধু পরিবার।
জাহাজ সাগরের বুকে দুলে দুলে এগিয়ে চলে, চারিপাশের অথৈ জল দিগ্‌ বলয়ের সীমা অবধি জাহাজ খানিকে ঘিরে ফেলেছে। নীল আকাশ দিগন্ত মেধের আবছায়া সৃষ্টি করে সাগরের প্রন্তকে ঢেকে দিয়েছে। সূর্যের আলো তেমনভাবে আত্মপ্রকাশ করে না, চারিপাশেই সম-পরিবেশ। জাহাজের তবু দিকভুল হয় না, স্থির লক্ষ্যে সে এগিয়ে চলে, কম্‌পাশের কাঁটা ঠিক থাকে।
ষোলবছরের মেয়ে বসে বসে ভাবে আর নিজের মনকে দৃঢ় করার চেষ্টা করে। বারো বছর বয়সে সে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছে, তারপর এই চার বছর পিতার কাছে সে পড়াশুনা করেছে, পিতা চান মেয়ে বিজ্ঞানশিক্ষা করুক, তিনি নিজে বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানেই তাঁর আকর্শণ বেশী। মেয়ের কিন্তু ভালো লাগে, শেলী, ব্রাউনিং, টেনিসন পড়তে। শুধু পড়াই নয়, সে লিখতেও পারে। সেই লেখার জন্যই আজ তার বিলাত, যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। তার ছোট নাটিকা পড়ে নিজাম বাহাদুর তাকে বিলাত যাবার টাকা দিয়েছেন। বিলাত থেকে ভালো করে পড়াশুনা করে ইংরাজী ভাষাটা আলো ভালো করে আয়ত্ব করতে হবে, তারপর তার কবিতা একদিন শেলী, ব্রাউনিং, টেনিসনের সঙ্গে সমপর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে, অমর হয়ে থাকবে তার নাম।
খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা নিঃসঙ্গতাকে জয় করে। জাহাজের রেলিং ধরে সে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকে অস্তগামী সূর্যের বিচ্ছুরিত রক্তিম রেখার পানে। বর্ণোজ্জল পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করে।
সরোজিনী বিলাতে এসে নামলেন বটে, কিন্তু প্রথমেই তাঁর আশা প্রতিহত হোল, বয়স কম হওয়ার জন্য ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রবেশ করতে পারলেন না।
দু’বছর তাঁকে লণ্ডনের কিংস কলেজে পড়তে হয়, তারপর আঠারো বছর হলে তবে তিনি ক্যাম্‌ব্রিজের গর্টন কলেজে ভর্তি হন।
স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় বেশীদিন তিন পড়াশুনা চালাতে পারেন নি, তিন-বছর বাদেই তাঁকে দেশে ফিরে আসতে হয়। ডিগ্রি তিনি আনতে পারেননি,সত্যি, কিন্তু কবি-খ্যাতি নিয়ে আসেন। তাঁর ‘গোল্‌ডেন থ্রেসোল্‌ড’, ‘বার্ড অফ টাইম’, ‘ব্রোকেন উইঙ্গ’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ ইংরাজী সাহিত্য-রসিক মহলে বিশেষ খ্যাতিলাভ করে।
এই খ্যাতির জন্যই মহামতি গোখলে একদিন তাঁর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন—‘তোমরা শক্তি, সামর্থ‍্য, সঙ্গীত, বচন, তোমার চিন্তা, তোমার স্বপ্ন দেশমাতার চরণে নিবেদন কর’।
সে আহ্বান সরোজিনী উপেক্ষা করতে পারেননি বলেই বিপ্লবী ভারতের জনগণের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পরাধীন দেশে দেশ সেবিকা সরোজিনী নাইডু ছিলেন কবি সরোজিনী নাইডুর চেয়ে ঢের বেশী পরিচিতা, সম্মানিতা মহিয়সী।

শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত

এলাহাবাদের জেলখানা।
ঝিম্‌ঝিম্‌ করে সারাটা দিন বৃষ্টি হচ্ছে, সারা আকাশ কালোয় কালো হয়ে গেছে। জেলখানার পাঁচিলের মতই মেঘগুলি চারিপাশের আলোকে আড়াল করে ফেলতে চায়।
ব্যারাকের ছাদ বেয়ে জল পড়ছে, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নানা ফুটো দিয়ে পথ খুঁজে নিচ্ছে নীচে নামবার। বাইরের রিমঝিমের সঙ্গে ভিতরের সুর মিলছে টিপ্‌ টিপ্‌ টিপ্‌।
ব্যারাক জলমগ্ন। কোথাও একটুকু দাঁড়াবার স্তান নেই। তবু তারই মধ্যে কোন রকমে মাথা বাঁচিয়ে এক মহিলা বসে আছেন। মাথায় গায়ে জল পড়ছে না বটে, কিন্তু পায়ের নীচে জল থৈ থৈ করছে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ঢং ঢং করে সাড়ে সাতটার ঘন্টা পড়লো। আলোর চারিপাশে পোকার ঝাঁক ঘুরছে, তারই দু’পাঁচটা বারবার গায়ে এসে পড়ছে। আলোটা নিভিয়ে দিলে পোকাগুলো সব চলে যায় কিন্তু এরই মধ্যে আলোটা নিভিয়ে দিতে মহিলার ইচ্ছা করছে না। চুপ করে তিনি বসে আছেন, বাহিরের অন্ধকারের পানে, বৃষ্টিধারার পানে তাকিয়ে তিনি ভাবছেন—অতীতের পৃষ্ঠাগুলির উপর দিয়ে তাঁর মন এগিয়ে চলেছে। দেশকে ভালবাসার জন্য একদিন দেশের লোক তাঁকে মন্ত্রীর আসনে বসিয়েছিল, সেই দেশসেবাই আজ অপরাধ বলে গণ্য হয়েছে, তাঁকে আসতে হয়েছে জেলখানার এই সহস্র-ছিদ্র ব্যারাকে। পরাধীন দেশে স্বাধীনতার স্পপ্ন যাঁরা দেখেন এই তাঁদের চিরন্তন পুরস্কার। হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতা এগিয়ে আসছে, কিন্তু পরাধীন দেশের শাসন-রীতি কিছুই বদলায় নি।
পোকাগুলো বড্ড জ্বালাতন করে, কিন্তু এতো সহজে চঞ্চল হলে তো চলবে না, তাঁর জেলে আসা তো আর এই প্রথম নয়। কিছুক্ষণ বই পড়লে মন্দ হয় না। তার আগে ডায়েরীটা লিখে নি—
মহিলা ডায়েরী খুলে লিখতে সুরু করেন—১৬ই আগষ্ট, ১৯৪২
এই কদিন আগে উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী ছিলেন, আজ তিনি উত্তর প্রদেশের জেলখানায়।
এই মহিলাটি কে জান? শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। প্রচুর বিত্ত এঁর চিত্তকে দেশপ্রেম থেকে বঞ্চিত করেনি। শুধু ইনি নন, এঁনার বাবা, ভাই, বোন, স্বামী, মেয়ে—কারাবাস থেকে বঞ্চিত হন নি কেউই।

মাতঙ্গিনী হাজরা

শহর থেকে আট মাইল দূরে ছোট গ্রামখানির বুকে গান্ধিজীর বাণী এসে পৌঁছলো—করেঙ্গে বা মরেঙ্গে। দেশের স্বাধীনতার আহ্বান করতে হবে—মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।
গ্রামের একপাশে স্বল্প পরিসর ছোট কুঁড়েঘরখানির দাওয়ায় বসে তিয়াত্তর বছরের বুড়ী চরকা কাটছিলেন, শরীরটা আজ ভালো নেই, গান্ধিজীর নামে সিন্নিজল খেয়ে বসে আছেন। ছেলের দল গিয়ে বললো—গান্ধি-বুড়ী, আমরা তমলুকের কোর্ট দখল করবো, এখন আর চুপ করে বসে থাকলে চলবে না।
বুড়ীর হাতের চরকা থেমে গেল, প্রশ্ন করলেন-পুলিশের সঙ্গে লড়াই করবি?
--অহিংসার লড়াই, বরাবর গিয়ে নিশান তুলবো কোর্টের উপর, থানা আমাদের হয়ে যাবে।
--গান্ধিজীর অহিংসার লড়াই।–বুড়ীর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বললেন—আমি যাব তোদের সঙ্গে।
সারা গ্রামের ছেলে-মেয়ে এসে জড়ো হয়েছিল, বুড়ী তাদের মাঝে এসে দাঁড়ালেন। একজন ফাজিল ছেলে বললো—পুলিশ কিন্তু গুলি চালাবে বুড়ী।
পুলিশ গুলি চালাবে। বুড়ী বললেন—বেশ, নিশান দে আমার হাতে, আমি যাব তোদের সবার আগে, যদি গুলি খেয়ে মরতে হয়, আমিই আগে মরবো, ভয় কি চল। মহাত্মা গান্ধীর নাম করে চল্‌ দিকি, কোন ভয় থাকবে না, আমারই জিতবো।
বুড়ী নিশান নিয়ে অগ্রসর হলেন সবার আগে, ছেলের দল পিছনে সাড়া তুললা—জয় মহাত্মা গান্ধি কি জয়। স্বাধীন ভারত কি জয়।
দীর্ঘ পথ, গ্রাম থেকে কোর্ট আট মাইল রাস্তা। তিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধা, গায়ের চামরা কুঁচকে উঠেছে কিন্তু মনের তেজ এতটুকু মলিন হয়নি, সে আজ হাজার হাজার জনকে পথ দেখিয়ে চলেছে, পদক্ষেপ তার দৃঢ়।
কোর্টের সামনে এসে যখন তারা দাঁড়ালো, পুলিশের বন্দুক তখন সঙীন উঁচিয়ে অভ্যর্থনা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তারা হাঁক দিল –খবরদার।
তমলুক মহকুমার অতিরিক্ত হাকিম অনিল ভট্টাচার্য পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, বুড়ী তাকে লক্ষ্য করে বললেন—তুমি কার উপর গুলি চালাবে গারোগা বাবু, দেশ তো আমাদের, আমরা আজ থেকে স্বাধীন হয়ে গেছি, তুমিও এসো আমাদের সঙ্গে—
কিন্তু বেতনভুক্‌ পরানুগ্রাহী হাকিমের কানে সে কথা ঢুকলো না, বললো—এগিও না বলছি, গুলি চলবে।
বুড়ী কিন্তু থামলেন না, পিছনে যারা ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল তাদের পানে ফিরে বললেন—এগিয়ে এসো, ভয় কি। মহাত্মা গান্ধী কি জয়।
হাকিম আদেশ দিল—গুলি চালাও।
পুলিশ গুলি চালালো। গান্ধী বুড়ীর হাতে এসে গুলি লাগলো, নিশান কিন্তু হাত থেকে পড়লো না, আলো শক্ত মুঠিতে নিশান ধরে সে এগিয়ে চললো, এসে পড়লো একেবারে সামনে। গুম্‌ গুম্‌ করে কয়েকটা গুলি চলে গেল—সোজা গুলি চলে গেল বুড়ীর কপাল ভেদ করে, বুড়ী ঘুরে পড়ে গেল। রক্তের ঝলকে মাটি লাল হয়ে গেল। তিয়াত্তর বছরের বুড়ী বুকের রক্ত দিয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্য পতনের সূচনা করে গেলেন।
এই মহিলাটি কে জান?—মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা। অতি সাধারণ চাষীর ঘরের মেয়ে, লেখাপড়া জানতেন না, কিন্তু অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন ভারতের আদর্শকে।



0 Reviews