Read more
সাগর রাজকন্যা
এ রাজা-মশাই-এর আসল নাম কি ছিল জানো?
পিঞ্জল। পিঞ্জরে যাঁরা হীরামন পুষতেন তাঁদের নাম হত পিঞ্জল—সোজা নাম, যার মানে হয়।
আর তাঁরা মেয়ের বরকে আদ্ধেক রাজ্য দান করে দিতেন বিয়ের দিনে। রাজ্য দান করবার সময়ে
তিনি আমাদের কুমারের নাম দিলেন সুদানু। সেকেলে হলেও কী আরামের দিন ছিল দ্যাখো।
কেমন দান পাওয়া যেতো।
কিন্তু সুদানু কি ঠাণ্ডা ছেলে যে দান পেয়ে
চিল্কার ধারে চুপচাপ বকের মতো বসে ভাববে ঃ মৎস্য ধরিব খাইব সুখে। দশবছর কেটে গেল
তবু সে ঠিক আগেকার মতোই দুরন্ত।
কাকের মতো উড়তে ইচ্ছে করত তার—কাকের মতোই
যাচ্ছেতাই সব খেতে ইচ্ছে করত। হীরামনটাকে কেটে সাবাড় করে দেবে ভেবেছিল তাই।
আর তাই বিয়ের পরদিন থেকেই দেখা গেল হীরামন
বেচারী বেজায় চুপ মেরে গেছে। তাই-তাই দিয়েও কথা কওয়ানো যায় না। পাখী কেন বেজার হল
সেদিনে তা-ও ছিল একটা ভাববার ব্যাপার। ডাক্তার-বদ্যি ডাকা হল। কথা কওয়াতে গিয়ে নাক-কান
কাটা গেল তাঁদের। কিন্তু রাজরাণীর হুকুম, কথা কওয়াতে না পারলে ডাক্তার-বদ্যিদের
হাঁক-ডাক ঘুচিয়ে মাথায় ঘোল ঢেলে রাজ্যি থেকে বিদেয় দেওয়া হবে।
বদ্যি পাড়ায় ডামাডোল-পালা রে পালা।
সুদানুর সাধারণ একটু ইচ্ছেতে কেমন লণ্ডভণ্ড
কাণ্ড দ্যাখো। অবশ্য তোমরা তা-ই ভাবছ বটে, কিন্তু সুদানু ভাবছে অন্যকথা। ভাবছে,
ব্বাবা কি দেশে এসে পড়লাম, পাখীর অসুখে মানুষদের ধরে ধরে নাকাল করে। আর আমার কি না
মতলব সে-পাখী পেটে পুরবার। দুত্তোর, তার চাইতে ঢের ভালো জলকন্যা নিয়ে সমুদ্রে ভেসে
পড়া। পাখী-পাগলী স্থলকন্যা থাক তার বাপের রাজত্ব নিয়ে। পাখী-পোষা দেশে আমার পোষাবে
না।
বিষ্ণুশর্মাকে খবর পাঠান হল যেদিন হীরামনের
তোয়াজ করবার জন্য সেদিন সুদানুর পিলে চমকে উঠল। পশু-পাখীর সঙ্গে না কি কথা বলতে
পারেন ওই পণ্ডিতমশাই। বোবার মুখে কথা ফোটাতে জানেন।
সুদানু জানত, পাখীরা যে মানুষের মনের কথা
বুঝতে পারে। বিষ্ণুশর্মা আসবেন শুনে ভালো ভাবেই মনে পড়ল তার পাখীর এই ক্ষমতার কথা।
বিষ্টুঠাকুর এসে যেই মন্ত্র পড়বেন ওমনি হয়ত হড়হড় করে হবুচন্দ্রের হরবোলা বুলি
ঝাড়বে ঃ
বোরোবূদূরের তোতা
শুনেছ কেউ কোথা
পোলাও মাংস হয়—
হলেও অমন ভোঁতা
রাজার ছেলের নয়।
তারপর যে কি হবে কে জানে বাবা। দেখতে কন্যের
বাবা অবশ্যি হাবাগোবা মানুষ তবে অমন মানুষই ত রাগলে বেহুঁশ হয়ে যান। না, ইলা, ছেলে
কেউ আর তখন আস্ত থাকবে না—পোস্ত গুঁড়ো বানিয়ে ফেলবে। বুনো জাত, দোস্তকেও চট করে
দুষমন ভেবে বসে। তার চাইতে ভালো মতলবটা ভাঁড়িয়ে চম্পট দেওয়া গা ঢাকা দেওয়া দিন
কয়েকের জন্য। তদ্দিনে হীরামনের মনও জুড়িয়ে বরফ সাদা হয়ে যাবে। যাবার দিনে না হয় ওর
বুড়ো নখে গড় জানিয়ে যাওয়া যাবে একটা।
সুদানুকে ত তোমরা চেনো। যেমনি ভাবা তেমনি
কাজ। একটুও দেরি সয় না মন।
তাই মাথা চুলকে পিঞ্জল রাজার দরবারে হাজির
হল জামাই। বললে চোখ নীচু করে ঃ ‘বড্ড ইচ্ছে আমার সমুদ্র-পাড়ি দোব’।
ক্ষত্রিয় রাজা—শুনে খুশী হলেন। এমনি সাহসী
ছেলে না হলে কি যেচে তিনি জামাই করেছেন তাকে? বললেন ঃ ‘বেশ ত কথা’। তারপর দরবারের
দিকে তাকিয়ে হাঁকলেন ঃ ‘শুনুন সভাসদ-মশাইরা – আপনারা যদি সপ্তগ্রামের রাজার ছেলের
সঙ্গে কেউ সাগরে যেতে চান ত যেতে পারেন। এঁর গুণের পরিচয় ত সবাই পেয়েছেন’।
রাজাকে খুশী করবার জন্যে দু’চারজন রাজি হয়ে
গেলেন তক্ষুনি।
চিল্কার ধারে আবার ভিড় জমে গেল। পটুয়ারা
হাঁড়ি ভাত রং গুলে মই চড়িয়ে জাহাজ চিত্রতে লেগে গেল।
গেল-গেল, যাচ্ছে যাবে রবে সরগরম হয়ে উঠল গরম
বালুর উপর দাঁড়াল মানুষের দল দিন কতক।
তার আগেই—জাহাজে দড়িদড়া-পাল খাটানো শুরু
হবার আগেই, হীরামনের পায়ে ধরার কাজটা সেরে ফেললে সুদানু। পক্ষী-জাতি অল্পেতেই
খুশী। সুদানু যখন বললে ঘাট হয়েছে রাজ-পক্ষী ওমনি পক্ষীরাজ ঘাড় দুলিয়ে খটাখট আওয়াজ
তুললে ঃ
‘আমাদের তুই কেউ ত না
যেথায় ছিলি সেথায় যা’।
তক্ষুনি কিন্তু তোতার মাংস ভক্ষণের সাদ
মেটাতে পারত আমাদের কুমার কিন্তু তা না করে চুপচাপ সটকে পড়ল।
তার ফলও ফলল অদ্ভুত। সোরগোল পড়ে গেল
রাজপুরীতে, জাদুকরের কাজ করেছেন জামাইবাবু-রাজা। হীরামনকে কথা বলিয়েছেন। ঢিঢি
নামডাক। ডাক্তার বদ্যির মুখে চুনকালি। বরাত ভালো থাকলে এমনি হয়। বরাত ভালো মানেই
তা-ই। তুমি যা করবে তাতেই লোকে তোমায় ভালো বলবে যখন তখন আমরা বলব, তোমার বরাত
ভালো। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। কুমারকে আর কেউ না জানুক, তোমরা ত জানো।
যাক্, তারপর কি হল শোনো। রাজা পিঞ্জল
সুদানুকে জিজ্ঞেস করলেন ঃ ‘কোথায় যাবে বলো—সমুদ্দুর ত তিন দিকেই –কোন দিকে যাবে?’
‘সূর্যের দেশে’। চট করে জবাব দিল সুদানু।
‘ভালো, তাহলে আমার একটা চিঠি নিয় যাও—ছেলেবেলায়
যে অরুণবরুণ কিরণমালার দেশের কাহিনীর কথা পড়েছো, সেখানে এখন আমার বন্ধু ধুম্রাজ
রাজত্ব করছেন—তোমায় পেলে খুব যত্নআত্যি করবেন’। বিরাট রাজা বুক ফুলিয়ে তাঁর
খাতিরের খ্যাতি শোনালেন জামাইকে।
‘তাই দিন’। সুদানু বললে। মনে মনে ভাবলে ঃ
‘ধুম্রাজ – সে আবার কি গো’।
সেদিনে চিঠি-লেখাও দুগ্ গোচ্ছব। পাইক ছুটল
আচার্য বাড়িতে। তাঁরা মূর্তি গড়তেন, কল্কা আঁকতেন, কল্কা থেকেই ‘ক’ থেকে ‘ল’
পর্যন্ত অক্ষরগুলো তৈরী করতেন। তাই কল্কার নাম কল্কা। অক্ষর আঁকা কলের চাকা গড়িয়েও
কেউ-কেউ ক-খ ফুটিয়ে দিতেন কাঁচা মাটির ইঁটের উপর। লঙ্কাদেশের নাম শুনেছ ত?
রাবণ-রাজার দেশ। অক্ষরের কারিগররা সেখানে থাকতেন সবাই। সবাই তাঁরা কালো কুচকুচে
ভুঁড়ি ওয়ালা ভুতুড়ে বামুন। ডাক নাম ভূশণ্ডির কাগ। কেউ কেউ ভুঁইঞাও বলতেন তাঁদের।
পিঞ্জল রাজার খাতাঞ্জিই ছিলেন এমনি এক ভুঁইঞা কাগ।
খাগের কলমে ছেঁচা তুলো দিয়ে তৈরী কাগজের উপর
লিখতেন তাঁরা। হত্তুকী আর লোহা ভিজিয়ে কালো কালি তৈরী করতেন, তার াম ছিল হিরাকস।
হীরামন, টিয়ে কাকাতুয়া, ময়না, বুলবুলি এসব পাখীকে বুলি শেখাতেন তাঁরা-ই। তবে
ভুঁইঞা হয়ে গেলে কাক-বিদ্যা ছেড়ে দিতেন।
ছিঠি লেখার তোড়জোড় চলছিল যখন তখন সুদানু আর
ইলা হেসে কুটোকুটি। বলছি বটে ইলা কিন্তু কুমারের যেদিন নাম পাল্টানো হল, সেদিনও
বললে—ওর আসল নাম মায়া। এখন বলো ত, মায়া কেন হাসছে? কথাটা এতোক্ষণ বলিনি তোমাদের। ঠিক
হয়ে দিয়েছিল সুদানুর সঙ্গে যাবে মায়া। ব্যাটাছেলের মতো পোশাকই ছিল তার পছন্দ—ব্যাটাছেলেরা
যা করবে সে-মেয়ের তা-ই করার দিকেই ছিল ঝোঁক বেশি। রাজাদের মৃগয়া যেতে হত বলে একদিন
সুদানু যখন হরিণ-শিকার করতে গয়ার জঙ্গলে গিয়েছিল তখন সঙ্গে ছিল এই মায়া মেয়ে। হাতে
একটি গুলতি। সেদিনকার বন্দুক-কন্দুক তা-ই ছিল। সুদানুর হাতে এক ধনুক চড়িয়ে দিয়েছেন
রাজা—বেচারী ধনুকের ছিলা-ই পরাতে জানে না, তীর ছুঁড়বে কি—হরিণ-শিকার ত দূরের কথা।
সুদানু সুধন্বা মোটেও নয়। কিন্তু একটি হরিণও যদি সঙ্গে করে না নিয়ে যেতে পারে
তাহলে ক্ষত্রিয় রাজা পিঞ্জল আফসোস শুরু করবেন। ভাববেন, কি বোকা ভীরু ছেলের সঙ্গেই
না রাজকুমারীর বিয়ে দিলেন—আদ্ধেক রাজত্বের মালিকানা ছেড়ে দিয়ে। এ-মুশকিলের আসান
করে দিয়েছিল সেদিন মায়া। গুলতির একটি গুলি ছুঁড়ে এক চিত্রা হরিণের একটি বিঁধে
ফেলল। দৌড়ে পালাবে কি হরিণ—মাথা ঘুরে বসে পড়ল—আর সে অবসরে সুদানুর সঙ্গী সাথীরা
চিত্রাকে বেঁধে ফেললে।
শিকার সেরে রাজধানীতে ফিরে এলো যখন, তখন
দ্বিতীয় দফায় তার নাম ফেটে পড়েছে।
কুমার এখন হাসছিল রাজার বাড়ির তামাসায়।
এখানে সব কিছুই পাল-পার্বণ হয়ে উঠেছে। গাছের একটি পাতা হঠাৎ হাওয়ায় নড়ে উঠলে তাঁরা
ভাবেন, বায়ু-দেবতা এলেন। মায়া কিন্তু তা ভেবে হাসছিল না। কুমারকে নিয়ে পালিয়ে
যাবার আনন্দে আটখানা হয়ে যাচ্ছিল যক্ষিনী মেয়ে।
যক্ষিনী মেয়ে । আগেকার দিনে ওঁরা ছিলেন।
অদ্ভুত সব কাজ করতে পারতেন—যা কেউ স্বপ্নেও দেখতে পায় না। পুরুষদের ওঁরা কোনো কাজ
করতে দিতেন না। বলতেন, ‘বসে-বসে খাও-দাও ঘুমোও—যা করবার আমিই করব’।
মায়াবতী তেমনি মেয়ে। মনে পড়ে ত তোমাদের
সোনার আর রুপোর কাঠির কথা? ওর মরা আর বাঁচা কেমন অদ্ভুত, মনে আছে ত? ও যাদুর দেশের
মানুষ।
সুদানুর আর মায়ার খুব ভাব। পিঞ্জল রাজার
মেয়ে পিঙ্গলার সঙ্গে-ও ভাব আছে সুদানুর, তবে তেমনটি নয়।
চিঠি লেখা হল পদ্যের মতো অক্ষর মিলিয়ে ঃ
মণিময় সম্রাজ সপ্তনাগেষু—
বর্মণ ধুম্রাজ কাঞ্চী রাগেয়ু
পত্রং ইদং কার্যং চ আগে হে
জামাতাজীবন সুদানুভাগে যে...
চিঠির চারটি কথা পড়েই ত জামাত-জীবনের মাথায়
চাটি। জামাইরা ছিলেন শ্বশুর মশাইদের জীবন—এই নাকি শ্বশুর-মশাই-এর জীবনের উপর দরদ।
ইনিয়ে-বিনিয়ে জামাই-এর ভাগবার কথাটিই ত জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি বন্ধুকে। আর সম্রাট
বন্ধুমশাইও নিশ্চয়ই বন্ধুর জামাইকে পেয়ে পক্ষীর মতো খাঁচায় পুরবেন।
চিঠি ছিল পদ্মের কল্কা-আঁকা একটি সোনার নলে
পোরা। ছিঠিটিকে ছিঁড়ে ফেলবে, সুদানু ভাবলে। নলটি ভেঙে বর্মী-স্যাকরা দিয়ে মায়ার
জন্য দানা-হার গড়িয়ে দেবে। দরবারে হাজির হয়ে রাজা পিঞ্জলের নাম বললে যদি বর্মার
ধুম্রাজের মন না ভেজে তাহলে বঙ্গ-সাগরের সব জল ঢেলেও তাঁকে ঠাণ্ডা করা যাবে না।
দেখাই যাক না খালি হাত-পায়ে গিয়ে কি অবস্থা দাঁড়ায়।
জাহাজ ভাসল আবার লোক-লস্কর নিয়ে। দোতলা
জাহাজ এবার-নিশানা ঘর সমেত দোলমঞ্চের মতো তেতলা। নিশানা-ঘর মানে মঠের চূড়োর মতো
মাস্তুলের নিচেকার ঘরখানা।
মাঝ-দরিয়ায় এসে গেলো জাহাজ এক প্রহর না
পেরোতেই। প্রহর বলতে কিন্তু ঘন্টা বুঝো না। প্রহর ছিল তিন ঘন্টায়। প্রহরীর বেলায়
তিন ঘন্টা পাহারার কাজ ছিল কি না, তাই তিন ঘন্টায় ছিল প্রহর।
ভোর আটটার সমুদ্র কি কেউ দেখেছ তোমরা? কখনো
মনে হবে দুধের সাগর, কখনো বা রুপোর। তবে মাঝ-দরিয়ায় ও অজগর—দুলে দুলে নিঃশ্বাস
নিচ্ছে—রূপোলি ঢেউ সব যেন দুধরাজ সাপের গায়ের আঁস। আর কী হু-হু হাওয়া।
তেতলায় মাস্তুল-ঘরে মায়া আর কাপ্তান সুদানু
বসে। দোতলায় রাজ-সভাসদ যাঁরা এসেছেন তাঁদের ঠাঁই। একতলায় দরিয়ার দাঁড়ী মাঝি মাল্লা
লস্করের দল। তাঁরাই জাহাজ চালান। কাপ্তান সুদানু উপর থেকে হেঁকে বলে দেন কোন্
দিকে যেতে হবে। সুদানুকে মায়া বলছিল ঃ ‘সিংহলে কিন্তু তোমায় যেতে দিচ্ছিনে—চলো
এবার সিঙ্গাপুর, তারপর বোরোবূদূরের দেশে’।
‘সিঙ্গাপুর’—মায়ার মুখ থেকে খপ্ করে
কাপ্তান সুদানু কথাটা কেড়ে নিয়ে বললে ঃ ‘সেকী যে আবার কোন্ দেশ?’
‘আমার সূয্যি মামার দেশ’। মায়া বললে।
‘সূয্যি আবার কারো মামা হন না কি?’ সুদানু
ভুলেই গিয়েছিল যে মায়া ঠিক-ঠিক তার মতো মানুষ নয়।
‘আমার হন। দেখবে কি আশ্চর্য দেশ—চিল্কায়
দেখেছ পাখীরা কথা বলে মানুষের মতো – ওখানে দেখবে মানুষরা সাপ আর মাছের মতো সমুদ্রে
নেমে খেলা করে’। মায়া ময়েল সাপের মতো আহ্লাদে কোঁচকানো দেখালে।
সুদানু হঠাৎ মুখভার করে ফেলেছিল বলেই মায়া
নিজেদের দেশের মায়াবী গল্প জুড়ে দিল আগড়-বাগড় কথা বলে। মায়ার বুকনি থেমে গেলে
সুদানু বললে ঃ ‘জানো মায়া—আমিও ভেবে রেখেছি সিংহলে যাব না। বাবা সিংহলে যেতেন –
শেষে একবার আর ফিরলেন না—তুমি ত তা জানো’। মায়াও বাপহারা সুদানুর ব্যথার ভাগী হয়ে
বললে, ‘আমি ত জলে ডুবে মরেই গেছিলাম। আমাকে বাঁচালেন তিনিই। তোমার সাথী করে দেবেন
বলেই বাঁচালেন’।
যক্ষিণী ছাড়া তেমন দয়ামায়া কারো ছিল না তখন।
তেমন মিষ্টি কথা বলতেও পারতেন না আর কেউ। তা-ই ত ওদের নাম থাকত মায়া। মায়া মানে
কথায় আদর মাখানো, চোখে আলো আর জল মেশানো
রঙ, কালো-কালো আঙুর গুচ্ছের মতো চুল আর গায়ের রং ভোরবেলাকার চাঁদের মতো।
মায়ার মায়ায় পড়ে ঝিলকানো কূলহীন সমুদ্রে
চিল্কার নৌকো ভেসে চলল একটি দিন একটি রাত। তারপরও আরেক দিন আরেক রাত। নীচু আকাশ
ভরে মেঘ আসছিল একেক সময়—ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছিল দিগন্ত, কিন্তু আকাশের মাথায় উঠে
আসতেই মায়ার মন্ত্রে সব ঝুটি বাঁধা কালো মেঘ তুলোর পাঁজের মতো সাদা হয়ে যাচ্ছিল।
মায়া তা-ই সুদানুকে দেখিয়ে বলছিল ঃ ‘ওগুলো কি জানো কুমার-রায়, আকাশের ঘিলু’।
কি বলছে তার ইলু—সুদানু অবাক চোখে তাকিয়ে
রইল। তাছাড়া কুমার-রায় কি হে? ও যে রায়-মসাইদের ছেলে তা-ও কি তাঁর মরা বাবা ওকে
বলে দিয়েছেন? এমন সুন্দর মেয়েটিকে এখন ভীষণ খারাপ মনে হল সুদানুর। সমুদ্রে এসে
ফরিং-এর মতো কী ফুর্তি মেয়ের, কিন্তু চিল্কার রাজ-পুরীতে ছিল কেঁচো হয়ে। সুদানু
বললে ঃ ‘সত্যি বলবে, তোমার নাম কি—কোথায় তোমার দেশ?’
‘তোমার দেশই আমার দেশ—রূপোলি পাহাড়ের দেশ’।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা--?’
ভোরবেলাকার কাঞ্চনজঙ্ঘাই কি শুধু রূপোলি
পাহাড়? চাঁদের পাহাড় নেই?’
‘তাহলে বলো বর্মামুলুকই তোমার দেশ’।
‘নিকুবের দ্বীপেও ত পাহাড় আছে’।
‘ও-ত আমার মামা চাঁদ-সওদাগরের হিজল বনের
দেশ’।
‘যদি বলি আমি সেই চন্দ্রের দেশের মেয়ে’।
‘আমি বলব আমার মামীমারা-ও তা-ই ছিলেন। কতো
অজগরের গল্প বলতেন তাঁরা’।
‘তাহলে ত তুমি আমাদের জানোই’। বলেই মায়া
ফিক্ ফিক্ করে হাসতে লাগল দুষ্টু মেয়ের মতো।
আর সুদানুর চোখ সুগোল ছানাবড়া হয়ে গেলো, যখন
ও দেখতে পেলে জলকন্যা মায়ার দেহটি একটা সাপের চকোর ওয়ালা খোলসে ঢুকে যাচ্ছে।
সুদানু চেঁচিয়ে উঠবে কি মুচ্ছা যাবে ভেবে পাচ্ছিল না।,
ঠিক এমনি সময় সোরগোল উঠল জাহাজের
লোক-লস্করদের এলাকায়। তুপানের পাগলা হাওয়া লাগল জাহাজের গায়ে।
সর্দার দাঁড়ী, যোয়ান নুলিয়া ছিল, নন্দ তার
নাম। চেঁচিয়ে সাড়া না পেয়ে হুড়মুড় করে সারেঙ্গের ঘরে এসে ঢুকল।
ঢুকেই দেখতে পেলে দুয়োরানী ইলাবতী সরস্বতীর
হাতের বীণা নিয়ে ভোমরার মতো গুন্গুন্ আওযাজ তুলে সুর ভাঁজছেন আর তাই না শুনে
জামাই রাজা মজাসে ঘুমুচ্ছেন। জাহাজ যে ডুবোডুবো সেদিকে খেয়ালই নেই এঁদের।
নন্দকে দেখে মায়া মধুর মতো মিষ্টি গলায় সুর
তুলে বললে ঃ ‘কি খবর নন্দ?’
শ্বাস বন্ধ করে বললে নন্দ ঃ ‘জাহাজ সামলানো
যাচ্ছে না—বারবার দক্ষিণ ছুটছে জানোয়ারের মতো’।
‘মন্ত্র পড়া জাহাজ নাকি তোমাদের?’ দুয়োরাণী
মায়া মিহি মিহি হাসতে লাগলো।
কী হয়েছে আসল ব্যাপারখানা জানো? গোড়া থেকে
বলি শোন। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপে ছিল চাঁদ-সওদাগরের ঘাঁটি। মায়া সে দ্বীপেরই মেয়ে।
আমাদের কুমারের বাবা বাণিজ্যে যেতেন লঙ্কায়—রাশি রাশি মুক্তো নিয়ে ঘরে ফিরতেন।
চাঁদের ছিল প্রবাল-রত্ন। প্রায়ই সমুদ্রে দেখা হত দুই বণিক রাজার। চাঁদ বলতেন,
‘আমার প্রবালের সঙ্গে তোমার মুক্তোর বদল করো’। কুমারের বাবা ‘করব-করব’ বলতেন
কিন্তু রাজি ছিলেন না বলে পালিয়ে বেড়াতেন। তাই না একদিন ক্ষেপে উঠলেন চাঁদ-সওদাগর।
যুদ্ধ বাধিয়ে দিলেন কুমারের বাবার জাহাজের সঙ্গে গঙ্গার মোহনায়। সেকী যুদ্ধ। এক
জাহাজ থেকে মশালের মতো আগুনের গোলা ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে ত আরেক জাহাজ থেকে বাঁশের নল
ভর্তি গোখরা-কেউটে সাপ ছোঁড়া হচ্ছে। তাছাড়া পাথর-বৃষ্টি ত হচ্ছেই গলুই ভেঙে দেবার
জন্য। বর্শা আর তীরও ছোঁড়াছুঁড়ি হচ্চে জাহাজ দুটো খুব বেশি মুখোমুখি হলে। শেষটায়
আগুন ধরে গেল দু-জাহাজেই। ডুববি ত ডোব কুমারের বাবার জাহাজও ডুবল আর সঙ্গে সঙ্গে
চাঁদের জাহাজও। সে জাহাজে ছিল চাঁদের মেয়ে মায়া—বাবাকে জলতরঙ্গ আর সারেঙ্গ বাজিয়ে
শোনাত। বাপ-বেটি দুজনেই জলে ডুবল। তবে চাঁদের হাতে ছিল হিজল কাঠের লাঠি, শিবের বর
পাওয়া একটা কাঠের ত্রিশূল। ও ত্রিশূল যাঁর হাতে থাকবে তাঁর মরণ নেই। চাঁদ মুঠোতে
ত্রিশূল ধরে ছিল আর চেঁচিয়ে বলছিল মেয়েকে ঃ ‘ওটা ধরে নে মুঠোয়’। কিন্তু ধরবার আগেই
মায়া ডুবে গেল। ডুবল কুমারের বাবা যেখানটায় ডুবেছিলেন—সেখানটায় শিব-পুরী, ঠিক
সেখানটায়। শিব খুশী ছিলেন না কারো উপর—একজন মিথ্যেবাদী অপরজন লোভী। তাই চাঁদ যখন
মেয়ের খোঁজে ডুবুরি পাঠাতেন, শিবের সাকরেদ নন্দী তাঁদের বলি দিতেন এক-এক করে। প্রবাল
তৈরী হত সে রক্তে। শেষটায় আর কেউ এ তল্লাটে আসত না। কুমারই তারপর প্রথম এসেছিল।
তারপর যা যা হল তা ত তোমরা জানোই।
কিন্তু চাঁদ কি করতেন জানো না। সমুদ্রে তিনি
আর আসতেন না। দ্বীপের উপর মস্ত এক চুম্বক লোহার পাহাড় তৈরী করলেন তিনি। দ্বীপের
দুমাইলের মধ্যে কোনো জাহাজ এলে আর রক্ষে ছিল না। জাহাজে নোঙর আর শিকল থাকত লোহার।
সেই লোহাকে এমনি জোরে টানত চুম্বক-পাহাড় যে দাঁড়ি-মাঝি উল্টো দিকে জাহাজের মোড়
ঘোরাতে চাইলেও আর তা পরতেন না। সোঁ সোঁ করে কুমীরের মতো ছুটে চলত জাহাজ
চুম্বক-পাহাড়ের দিকে। তাই ছুটে চলছিল সুদানু-মায়ার জাহাজ।
নন্দর মুখে সে খবরই শুনল মায়া। জানালা দিয়ে
তাকাল কোন্ দিকে জাহাজ যাচ্ছে দেখবার জন্যে। দূরে লোহার বলের মতো একটা দ্বীপ দেখা
যাচ্ছিল। সিংহল দ্বীপ না কী? ভাবলে মায়া। বললে ঃ ‘সিংহলের দিকে যাচ্ছি কি আমরা?’
‘অন্ধদের মানদ্বীপ মালুম হচ্চে’—হনুমানের
মতো মাস্তুল বেয়ে উপরে উঠে বাঘের হালুম ডাকের মতো চেঁচিয়ে বললে নন্দ। লস্করদেরও
ডাক শোনাবার মতলব ছিল তার, সুদানুরও ঘুম ভাভানোর কাজ হবে তাতে ভাবছিল। সত্যি কাজ
হল। ঘুম ভেঙে উঠে বসল সুদানু।
নন্দ দুচোখ ভরে কেঁদে বললে ঃ ‘অন্ধ
ব্যাটাদের হাতে আমরা বন্দী হতে চলেছি মহারাজ’।
‘আন্দামানে এসে গেছি’। সুদানু একগাল হেসে
বললে ঃ ‘ভয় নেই নন্দ—ও আমার মামার দেশ’।
তখন আর নন্দকে পায় কে? লাফিয়ে উঠলো। চুটিয়ে
ফুর্তি করবার নেশায় লাফ মেরে সত্যি চাঁদের দেশে উঠে যায় আর কি। চাঁদের দেশের খবর
দেবার লোভে তিন ধাপ সিঁড়ি এক-এক লাফে পেরিয়ে মাল্লাদের ঘরে ছুটে গেল নন্দ।
মায়া কিন্তু তখন বোকা বনে গেছে। এঁরা কি সব
বলাবলি করছে? সত্যি কি সিংহল এসে গেলো—সুদানু কি তার মন ভোলাবার জন্য আন্দামানের
নাম বলছে? মায়ার যেন কেমন সব ঘুলিয়ে গেল মাথায় – চুপটি করে সুদানুর পাশে বসে ভাবতে
শুরু করলো। সত্যি কি তার নাম মরবার আগে মায়া ছিল, না অন্য কিছু?
দূরের লোহার বলের গায়ে তখন যেন কদমফুলের মতো
রোঁয়া দেখা যাচ্ছিল—তাল-নারকেল সুপুরী তমাল গাছগুলো ওরকম দেখাচ্ছিল দূর থেকে।
মায়াকে চুপচাপ দেখে সুদানুর মায়া হল এবার।
সাপের খোলসে মায়ার ঢুকে যাবার ছবিটা মনে হল স্বপ্নদেখা ছবি। সত্যি নয়। তাই বললে ঃ ‘চুপচাপ
বসে কি ভাবছ?’
‘ভাবছি একটা কথা’ কাঁদ কাঁদ দেখাল মায়াকে—কথাটাও
কান্নাভরা শোনাল।
‘কি?’
‘ভাবছি আমার নাম সত্যি মায়া ছিল কি না’।
‘সে কি?’ আবার অবাক হতে শুরু করলে সুদানু।
‘একটু-একটু মনে পড়ছে আমার, মরবার আগেকার সব
কথা—নব নীলচে ছবিগুলো’।
‘সে কি রকম ছবি?’
‘পরীর দেশের কথা শুনেছ? চাঁদ-সূর্য কিচ্ছু
নেই, তবু সেখানে নীল আলো—শরীরটাকে ধরলে ছুঁলে মনে হয় খানিকটা হাওয়া ছুঁয়ে নিলাম’।
‘ভারি মজার ত তাহলে’।
‘কখখনো না। নিজের সঙ্গে ছাড়া আর কারো সঙ্গে
কথা বলবার যো নেই তোমার। ছায়াতে মজা আছে বলো?’
‘ধরো সেখানে গিয়ে আমি বাবাকে দেখলাম। তিনিও
কথা বলবেন না?’
‘উহুঁ। বলতে চাইলেও বললেও, তুমি শুনতে পাবে
না’।
‘তাহলে কাজ নেই বাবা—তোমার ওসব কথা শুনে।
তুমি চুপ করেই থাকো’। সুদানু মায়াকে থামিয়ে দিলে।
মায়া চুপ করে গেল। কিন্তু চুপ করে গেলেই কি
তোমরা কথা বলা বন্ধ করে দাও? মনে মনে কথা বলো। মায়া মনে মনে বলতে লাগল ঃ ‘আমার নাম
ছিল মায়া ছাড়া আরো যেন কি। আমার বাবা ছিলেন চাঁদ সওদাগর। আমার ভাই ছিল লক্ষীন্দর।
মা ছিলেন সনকা। বৌদির নাম ছিল বেহুলা। সাপে কামড়ে ছিল একবার ভাইকে। মরে গিয়েছিল
ভাই। বৌদি সেই মড়া নিয়ে স্বর্গে গিয়েছিলেন তাকে বাঁচিয়ে আনবার জন্যে। বাঁচিয়ে এনেও
ছিলেন।...’
সুদানু কিছুই শুনল না—কিন্তু মায়া কথা বলতে
লাগল।
এদিকে কিন্তু জাহাজের মতি-গতি সিংহল
সিঙ্গাপুর যাবার দিকে মোটেও না। সরাসরি আন্দামান-নিকোবর দ্বীপের যক্ষ কূবের
রাজ্যের মাঝামাঝি ঢুকে পড়েছে। মাঝি-মাল্লার হৈ-হুল্লোড় লেগে গেছে মাটিতে পা বাড়াবার
জন্যে। দুদিন জলের উপর থাকলেই মটির জন্য আইঢাই লাগিয়ে দেয় সবাই। সাত সমুদ্দুর ঘুরে
বেড়াত কি না নেয়ের দল তাই কুল দেখলেই নামবার জন্যে আকুল হয়ে উঠত।
চাঁদ-সওদাগর মারা গেছেন বুড়ো হয়ে। তাঁর ছেলে
লক্ষীন্দর যখাই লখাই রাজা এখন দেশে। কুবের এসে তাঁর রাজধানী তৈরী করে দিয়েছেন
একপাল যক্ষ্য কারিগর দিয়ে। তাই একে কুবের-পুরী বলত সবাই—আসলে কুবের নেই এখানে—নিকুবের
পুরী—তাই থেকেই নিকোবর নাম। তেমনি আন্দামান মান—সম্মানেও অন্ধ যক্ষরাজাদের আমল
থেকে। চাঁদ-সওদাগর ছিলেন প্রকাণ্ড মানুষ, তেমনি তাঁর দেমাকও ছিল আকাশের মতো উঁচু।
শিবঠাকুর তাই না দেখে তাঁকে খুব জব্দ করে দিয়েছিলেন একবার। সে গল্প তোমাদের মা
বাবা বলতে পারবেন—শোনো।
চাঁদের ছেলে লক্ষীন্দর। লক্ষ্মী ছেলে।
চুম্বক-পাহাড়ের টান জাহাজ এসে তাঁর বন্দরে লাগলে তিনি যাত্রীদের নামিয়ে নিয়ে মস্ত
ভোজ দেন। যাত্রীরাও খুশী হয়ে তাঁকে দামী-দামী হীরা চুনি পান্না-মুক্তো-প্রবাল
উপহার দিয়ে যান জাহাজে ফিরে যাবার সময়। জলজান যা ছিল জাহাজের সেদিনের নাম, উল্টো
মুখে চলতে পারত চুম্বক পাহাড়ের গায়ে লোহার একখানা জামা পরিয়ে দিলে। সে-জামাটি
যক্ষরা তাঁকে তৈরী করে দিয়েছিলেন। এ-সব ভারী ভারী কাজ করতে পারলেই প্রকাণ্ড চেহারার
যক্ষরা খুশী হতেন। নিজেরা কিন্তু থাকতেন পাহাড়ের গর্তে লুকিয়ে, যাকে বলত গুহা।
যক্ষদের মেয়ে ছিল ঠিক মায়ার মতো দেখতে।
গোড়ায় গোড়ায় চাঁদ-সওদাগরের মতো গোঁয়ার রাজারা তাদের জোর করে ধরে নিয়ে আসতেন।
খাঁচায় পুরে সার্কাসের বাঘ ভালুকের মতো পুষতেন এনে। বলতেন এরা সব সাপ ভালুক হরিণের
মেয়ে। দেখে দেখে যখন আর বিশ্বাস হল না, তখন সার্কাসওয়ালারা যক্ষিনীদের বাঘ-ভালুকের
সঙ্গে লড়াই শেখালেন, ডন-কুস্তি শেখালেন, সরু তারের উপর দিয়ে হাঁটতে শেখালেন। আর
তখন নাম দিলেন ওদের ভানুমতী। ভানুমতী মানে ম্যাজিক-জানা মেয়ে। অনেক আগেকার কথা
এসব। তারপর মানুষেরা যখন ওদের বউ করে ঘরে তুলল তখন রটিয়ে দিলে ওরা সব সুর্যের
মেয়ে। ভানু মানে সূর্য কি না—তাই।
আন্দামান ঘাটেই গিয়ে ভিড়ল জাহাজ—সেখানে
লক্ষীন্দরের ঝিনুকমোড়া মস্ত প্রাসাদ। সাদা রং বলে প্রাসাদ—পোড়ামাটির রং হলে হত
পুরী। ঘাটের ছবি দেখে মায়ার যেন হুঁশ ফিরে এলো। মনে হল, এ ত তার সবই চেনা। কিন্তু
আমরা দেশ হলেও সুদানু এমন দেশ স্বপ্নেও দেখেনি কোনোদিন—সব অচেনা। শুধু সে শুনেছিল
চন্দ্রদ্বীপের মানুষদের মামা হত আন্দামানের মানুষরা। শোনা কথা এক রকম আর দেখা শোনা
আরেক রকম। বন্দরে দাঁড়ানো কালো-কালো জমকালো মানুষগুলোর রাক্ষুসে রকমসকম দেখে
সুদানুর কেমন ভয় ভয় করতে লাগল।
রাজার প্রাসাদ থেকে পাল্কী এসেছে সারেঙ্গকে
নিয়ে যেতে। আজ প্রাসাদে ভোজ লেগে যাবে মস্ত। দ্বীপের কারো বাড়িতে উনুন ধরবে না—সবার
নেমন্তন্ন রাজবাড়িতে।
সুদানু রাজপুরুষকে জিজ্ঞেস করলে ঃ ‘আমরা
কোন্ মহারাজের অতিথি হলাম বলতে পারেন?’
‘মহারাজ ধুম্রাজ’ ভারী আওয়াজে রাজপুরুষ
বললেন।
সুদানু আর মায়া ফ্যালফ্যাল করে এ ওর মুখে
তাকিয়ে বললে ঃ ‘আমরা তবে বর্মা দেশে এলাম’।
রাজপুরুষ বললেন ঃ ‘তা-ও বলতে পারেন। যখাই
লখাই মহারাজই এখন বর্মারও ধুম্রাজ?’
‘ও তাহলে বন্দরটা আন্দামানই—আমরা যা আন্দাজ
করেছি’ সুদানু মায়াকে বললে।
তালপাতার সেপাই এর মতো হঠাৎ নড়ে ওঠে
রাজপুরুষ বললেন ঃ ‘আজ্ঞে’।
কিন্তু লখাই নাম শুনেই মায়ার জিব তালুতে
লেগে গেল। কয়েকটা ঢোঁক গিলে বললে ঃ ‘লক্ষীন্দর মহারাজ?’
রাজপুরুষ আবারও তেমনি নড়েচড়ে বললেন ‘আজ্ঞে’।
ভাগ্যিস চিঠিটা তখনও ছেঁড়া হয়নি—হাঁপ ছেড়ে
বাঁচল সুদানু। দূরবীনের মতো ওটাকে বগলদাবা করে আজ্ঞে ওয়ালার সঙ্গে যাবার জন্যে
তৈরী হল। মায়া বললে ঃ ‘তুমি যাও, আমি জাহাজেই আছি’।
আজ্ঞে-ওয়ালা এবার বললেন ঃ ‘আজ্ঞে না’।
‘এসো না’ আগ বাড়িয়ে সুদানু বললে ঃ ‘শ্বশুর
মশাই-এর চিঠি ত আমার সঙ্গেই আছে। তাছাড়া তুমিও তো চেনো দেখছি মহারাজাকে’।
সুদানু যে ছেলে, শেষটায় এসব লোকজনের সামনেই
টানা হেঁচড়া শুরু করবে – ভালোয় ভালোয় তক্ষুনি রাজি হয়ে যাওয়া ভালো। মায়া যেতে রাজি
হল।
রাজি ত হল কিন্তু রাজসভায় হাজির হয়ে যে এমন
কাণ্ড ঘটবে তা কি মায়া জানত?
সত্যি তার ভাই লক্ষীন্দর তখন রাজা। ভাই ত
বোনকে দেখেই চিনে ফেলল। কিন্তু মায়া লক্ষীন্দরকে আরেক রকম দেখছিল। বেশ মোটা-সোটা,
চোখগুলো মিটমিট করছে—থুতনির নীচ আরেকটা গাল—সেই ছিমছাম লক্ষীন্দর আর নেই।
লক্ষীন্দর বললে ঃ কি করে তুই ফিরে এলি মায়ী?
কোথায় ভেসে গিয়েছিলি?
সুদানু তখন এগিয়ে গিয়ে পিঞ্জলরাজার চিঠিটা
লক্ষীন্দরের হাতে দিলে। তারপর বললে ঃ মহারাজ যা জানতে চাচ্ছেন তা এক অদ্ভুত
কাহিনী। এই না বলে সুদানু গঙ্গার ঘাট থেকে জাহাজ নিয়ে পালানোর কাহিনী আর চিল্কা
থেকে জাহাজে চড়ে পাড়ি দেবার কাহিনী, সব কথা, এক-এক করে রাজদরবারে জানিয়ে দিল।
সভার মানুষেরা টুঁ শব্দটি না করে শ্বাস বন্ধ
করে শুনল সব কথা। সব শুনে গালে ভাঁজ তুলে হাসল লক্ষীন্দর—মাংসের ঢেলার ঠেলা লেগে
চোখগুলো আর দেখা গেল না তার। হাসি থামলে তবে চোখ আর মুখ খুলতে পারল সাতটি সাপের
ফলা আঁকা মুকুট পরা ধুম্রাজ। তখন বললে ঃ আমাদের বাবারা বড্ড ঝগড়া করতেন। তুমি ভাই
ঝগড়া মিটিয়ে দিলে আমার বোন মায়ীকে আমার বাবার বন্ধুর বোন পিঙ্গলাকে বিয়ে করে।
তোমার আটটি সাপের ফণায় তৈরী মুকুট গড়িয়ে দেব
এদিকে মায়ী নাম শুনেই মায়ার আগেকার সব কথা
মনে পড়ে গেল। চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল বললে ঃ বাবা ত নেই, বুঝতে পারছি—মা আর বৌদি
বেহুলা বেঁচে আছেন ত?
রাজসভার দোতলার চিকের আড়াল থেকে তক্ষুনি
বেহুলা মুখ বাড়িয়ে –ডাকল ঃ মায়া ঠাকুরঝি।
রাজসভায় গুন গুন উঠল। মস্ত মস্ত পণ্ডিতেরা
বললেন হ্যা হ্যা মায়ীই বটে। আর সস্তাদরের মানুষরা এ ওর কানে বলতে লাগল ঃ
ছিল মোদের পাতার ভেঁপু হল এবার শানাই
কী আমুদে জামাই চলো তারি গল্প বানাই।
0 Reviews