Read more
পৌরাণিক যুগের
কথা।
দক্ষিণ ভারতের
শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র তখন অগস্ত্যের আশ্রম।
একদিন আশ্রমের
দ্বারে এসে দাঁড়ালো এক তরুণী, জানালো—মহর্যির জয় হোক, আমি আপনার কাছে শাস্ত্র
অধ্যায়ন করতে চাই।
--কোথা থেকে আসছ
মা, তোমার পরিচয়?
--আসছি তমসার
তীরে মহর্যি বাল্মীকির আশ্রম থেকে, নাম আত্রেয়ী।
--তমসা তীর থেকে
বন্ধ্যপর্বত পার হয়ে আসছ, এই বহু যোজন পথ অতিক্রম করে।
অগস্তমুনি ও তাঁর
শিষ্যবর্গ বিস্ময়ে তরুনীর মুখের পানে তাকালেন সোনার মত রং রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে
গেছে, গেরুয়া বেশ ধূলি-ধূসর, চুলে জট ধরেছে, গালের হাড় বক্ষ্যমান হয়ে উঠেছে, সারা
দেহে ফুটে উঠেছে কঠোর পরিশ্রমের রুক্ষতা, শুধু চোখদুটি ভাস্বর। উত্তরাপথের তমসার
তট থেকে যোজনের পর যোজন হাঁটতে হাঁটতে দুর্গম বিন্ধ্যপর্বত পার হয়ে এই মেয়েটি
এসেছে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে। অগস্ত্য সাদর আহ্বান জানালেন—এসো মা।
তারপর জিজ্ঞাসা
করলেন – কিন্তু মহামুনি বাল্মীকির আশ্রম ছেড়ে এলে কেন মা? সেখানকার পাঠ কি শেষ হয়ে
গেছে?
--না ভগবান,
সেখানে ঋক, যজু ও সামবেদের পাঠ শেষ করেছি মাত্র। ইতিমধ্যে সেখানে দুই রাজপুত্র
এসেছেন, লব আর কুশ। বয়স মাত্র বারো বছর, কিন্তু অপূর্ব দীশক্তি। তাঁদের পাঠাভ্যাসের
সাথে আমরা তাল রাখতে পারি না, মহর্যিও আমাদের প্রতি আর তেমন যত্ন নেই। সেইজন্য
তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আপনার কাছে এলাম।
--অপূর্ব তোমার
অধ্যাবসায় মা, তোমাকে ছাত্রী হিসাবে পেয়ে আমার এই আশ্রম আজ ধন্য হোল।
তারপর
অগস্ত্য-আশ্রমে চললো জ্ঞানচর্চা। অগস্ত কন্যার মত স্নেহে তাঁকে শিক্ষা দিতে
লাগলেন। দেখতে দেখতে সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিতা হয়ে উঠলেন আত্রেয়ী। বিদূষী হিসাবে
তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র দক্ষিণাপথে।
শবরী
পম্পা সরোবরের
পশ্চিম তীরে ছিল মতঙ্গ মুনির আশ্রম। সেই আশ্রমের সাধু সন্তদের পরিচর্যা করতেন একটি
মেয়ে। মেয়েটি অনার্যা কিন্তু সাধু-সন্তদের কাছে আর্য-আনার্য ভেদ ছিল না, মেয়েটি
তাই মতঙ্গ মুনির স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি।
শবরীর ঘী ছিল
অনন্যসাধারণ। ধর্মচর্চা শুনতে শুনতে সেও শাস্ত্রজ্ঞ হয়ে উঠলো। শেষে ঋষি একদিন তাঁর
শিক্ষার ভার নিলেন। তপশ্চর্যার সিদ্ধি-লাভ করে শবরী ‘সিদ্ধাশবরী’ হলেন।
ঋষি মৃত্যুকালে
শবরী জিজ্ঞাসা করলেন – আমার প্রতি কি আদেশ হয় গুরুদেব, আমার ভবিষ্যৎ কর্তব্যের
নির্দেশ দিন?
--এই সুপুণ্য
আশ্রমে এ যুগের শ্রেষ্ঠ পুরুষ শ্রীরামচন্দ্র একদিন আসবেন, তুমি তাঁর প্রতীক্ষা
করো।
শবরী প্রতীক্ষা
করতে লাগলেন। বসন্তের পর বর্ষা এলো, তারপর ফিরে এলো আবার বসন্ত। বছরের পর বছর
এগিয়ে চললো। মহাকালের চাকা ঘুরে চললো অনন্ত আবর্তনে। কিন্তু শবরীর শ্রান্তি নেই,
মৃগচর্ম সাজিয়ে ধুপ ধুনা চন্দনে সুরভিত করে রাখেন আশ্রমটি। কবে কখন শ্রীরামচন্দ্র
আশ্রমের পায়ে চলা পথে আবির্ভূত হবেন, জানা নাই তো।
শবরীর বয়স বাড়তে
থাকে, যৌবনের দীপ্তি লীন হয় বার্দ্ধক্যের শীর্ণতার মাঝে। দেহের শক্তি অশক্ত হয়ে
উঠে। তবু ধুপ ধুনা প্রতিদিন জলে, মৃগচর্ম চন্দন-চর্চিত হয় নিয়মিতই।
শেষে একদিন সত্যই
শ্রীরামচন্দ্র এলেন। জটাজুটশীর্ষ সন্ন্যাসিনী শ্রদ্ধা জানালেন—আজ আমার তপস্যা
সিদ্ধ হোল।
তারপর অতিথির
পরিচর্যা করে বললেন – আপনি প্রসন্ন চিত্তে এবার আমায় আশীর্বাদ করুন প্রভু। এ জগতের
সব কর্তব্য আমার শেষ হোল, এবার আমি মুক্তি চাই।
শ্রীরামচন্দ্র
আশীর্বাদ করলেন।
জলন্ত অগ্নির
মধ্যে শবরী দেহত্যাগ করলেন।
মহামানবকে একবার
অর্চনা করার জন্য, বারেক দর্শনলাভের জন্য এই যে সাধনা, তা মহাভারতের এই
পুণ্যভূমিতেই সম্ভব। শবরীর মত মেয়ের কথা আর কোন দেশের ইতিহাসে লেখে না।
মদালসা
দোল্নায় ছেলে
শুয়ে আছে, রাণী-মা গুণ গুণ করে ঘুমপাড়ানী গান গাইছেন—তুমিই ভগবান, তুমিই
ব্রহ্ম....
এমন সময় আরেক
রাজকুমার কাঁদতে কাঁদতে এসে বললো – মা, আমাকে ক’জন প্রজার ছেলে মেরেছে....
রাণী-মার মুখে
হাসি ফুটে উঠলো, বললেন – তোমাকে তো কেউ মারতে পারে না বাবা...
রাজকুমার বললো –
আমি রাজপুত্র ওরা কেউ তা মানে না, প্রজা হয়ে ওরা আমায় মারছে, তুমি ওদের সাজা
দাও...
মা বললেন—তোমায়
তো কেউ মারতে পারে না বাবা, তোমার দেহকে তারা আঘাত করেছে। এই দেহ তো আর তুমি নও।
তুমি হচ্ছ—শুদ্ধ আনন্দ জ্ঞানস্বরূপ আত্মা। রাজপুত্র প্রজাপুত্র বলে কিছু নেই, সবই
কল্পনা মাত্র, দেহের বিকারে তোমার মনের বিকার হওয়া উচিত নয়।
রাজকুমার ক্ষণেক
কি যে ভাবলো, তার পর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হোল। রাণী-মা আবার ছেলেটিকে ঘুম পাড়াতে
সুরু করলেন—তুমি ভগবান, তুমি ব্রহ্ম...
দেখতে দেখতে
বছরের পর বছর কেটে গেল। ছেলেরা বড় হয়ে উঠলো, রাজা ঋতধ্বজ ছেলেদের উপর রাজ্যের ভার
দিতে চাইলেন।
বন ছেকে
বিক্রান্ত বললো—রাজ্য আমি চাই না পিতা, যা মিথ্যা তার পিছনে ছুটতে আমি চাই না, আমি
সাধনা করতে চাই, আপনি অনুমতি দিন...
রাজা মেজ ছেলের
পানে তাকালেন। সুবাহু বললো – আমাকে অনুমতি দিন পিতা, আমি সন্ন্যাসী হব।
রাজা তৃতীয় কুমার
শত্রুমর্দনকে আহ্বান করলেন। সে বললো—রাজ্য আমি চাই না পিতা।
তিনটি ছেলেই
সন্ন্যাসী হয়ে গেল।
রাজা বললেন—রাণী,
ছোট ছেলেটা এখনও শিশু, তাকে আর এভাবে শিক্ষা দিও না, তাহলে রাজবংশ লোপ পাবে। সকলেই
সন্ন্যাসী হলে রাজ্য চালাবে কে?
রাণী মদালসা
কনিষ্ঠ পুত্রকে রাজনির্দেশ মত মানুষ করে তুললেন বড় হয়ে ছেলে রাজ্যভার গ্রহণ করলো।
রাজারাণী বানপ্রস্থে গেলেন। যাবার সময় রাণী-মা এক আংটীর মধ্যে কয়েকটা উপদেশ লিখে
দিয়ে গেলেন ছেলের হাতে। বলে গেলেন—যখন বিপদে পড়বে, তখন এটা পড়ে দেখো।
কিছুকাল পরে রাজা
অলর্ক সত্যই বিপদে পড়লেন। কাশীরাজ তাঁর রাজ্য ঘেরাও করে ফেললো, খাদ্যাভাবে প্রজা
মরতে লাগলো, অলর্ক শান্তি হারালেন। এমন সময় আংটির কথা মনে পড়লো, মায়ের উপদেশ বাহির
করলেন, মা লিখেছেন—সংসারে শ্রেয় কিছু নেই, ব্রহ্মলাভ করাই মানব-জীবনের শ্রেষ্ঠ
কাম্য...কামনার মধ্য দিয়ে মানুষ সত্যে পৌঁছতে পারে না... ইত্যাদি।
অলর্কের আর লড়াই
করা হোল না, রাজ্য ছেড়ে তিনিও সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন।
এমনিই ছিল প্রচীন
ভারতীয় মায়েদের শিক্ষা, যার ফলে রাজ সিংহাসনও তুচ্ছ হয়ে যেত। আজকের তিরিশ টাকা
বেতনের ভাবী-কেরাণী মানুষ করার সাথে সে আদর্শের কতো প্রভেদ।
সম্বুলা
স্বস্তিসেন কাশীর
রাজা হলেন।
কিন্তু বেশীদিন
রাজ্য করা চললো না। তাঁর হাতে পায়ে মুখে ব্রণ উঠতে লাগলো, সেগুলি পাকে, ফাটে, আর
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বীভৎস হয়ে ওঠে। রাজবৈদ্য বললেন—এ কুষ্ঠরোগ।
কুষ্ঠরোগ নিয়ে
রাজকার্য করা যায় না। সকলের ঘৃণ্য হয়ে সবার উপর সিংহাসনে বসে থাকা চলে না।
স্বস্তিসেন ঠিক করলেন রাজ্য ছেড়ে বনে যাবেন।
রাজপিতা বৃদ্ধ
ব্রহ্মদত্তকে আবার রাজ্যের ভার নিতে হোল।
স্বস্তিসেন ঠিক
করলেন—লোকালয় থেকে বহুদূরে বনের মধ্যে একটি কুঁড়েঘর তৈরী করে বাকী জীবনটা সেইখানেই
কাটিয়ে দেবেন, এই কুৎসিৎ দেহ নিয়ে তিনি আর লোকজনের সামনে আসবেন না।
যাবার বেলায় রাণী
সম্বুলা বললেন – আমিও যাব।
স্বস্তিসেন অবাক
হলেন, বললেন—তুমি কোথায় যাবে?
--তুমি যেখানে
যাবে।
--আমি যাচ্ছি
বনে, সেখানে দাসদাসী নেই, হিংস্র পশুর ভয় আছে। তুমি সেখানে থাকবে কেমন করে?
--তুমি সেখানে
থাকতে পারলে আমিও পারবো। আমি তোমার সহধর্মিণী, রাজকাজের সময় যেমন তোমার পাশে পাশে
আমায় থাকতে হয়েছিল, আজ তোমার পাশে থাকা তার চেয়েও বেশী দরকার, কারণ এখন আর কোন আত্মীয়
বন্ধু দাসদাসী তোমার কাছে থাকবে না।
সম্বুলা স্বামীর
সাথে বনে গেলেন।
রাজার মেয়ে,
রাজার বউ সম্বুলা, আজন্ম কোনদিন দুঃখকষ্টের মুখ দেখেননি, বনে এসে স্বামীর সেবায়
আত্মনিয়োগ করলেন ঃ ঘর ঝাঁটানো, নদী থেকে জল আনা, রান্না করা, ফলমূল সংগ্রহ করা,
স্বামীকে স্নান করানো ও কুষ্ঠের উপর বনৌষধির প্রলেপ দেওয়া—সবই সম্বুলা করেন দিনের
পর দিন, বিরক্তি নেই, ব্যতিক্রম নেই। দিনরাত চেষ্টা করেন স্বামী যাতে সুস্থ হন।
একাগ্রতার ফল
ফললো।
ধীরে ধীরে
স্বস্তিসেন সুস্থ হয়ে উঠলেন। তারপর একদিন হিমালয়ের সেই বন ছেড়ে স্বস্তিসেন ও
সম্বুলা কাশীরাজ্যে ফিরে এলেন। দেশজুড়ে ধন্য ধন্য রব বড়ে গেল, সতী সম্বুলার নাম
ছড়িয়ে পড়লো ভারতভূমির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত।
0 Reviews