Read more
এক বর্ষাকালে চারিদিক রোদে খাঁ-খাঁ করছে। কোথাও এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। মানুষজন
পশুপাখি সব বৃষ্টির অভাবে হাহুতাশ করছে। এমন সময় এক হাতির দল জলের অভাবে অত্যন্ত
অস্থির হয়ে পড়েছে। একটি হাতি তাদের দলপতিকে বলল, ‘প্রভু, চারিদিকে জলের জন্য
হাহাকার, আমরা তো আর পারি না’।
দলপতি বলল, ‘তোমরা একটা অপেক্ষা কর, আমি দেখি কিছু করতে পারি কিনা’। বলে সেই
দলপতি তখন তাদের ছেড়ে জলের খোঁজে বেরিয়ে গেল। হাতির দল তাকিয়ে রইল দলপতির দিকে।
যাহোক একটু পরে দলপতি এসে বলল, ‘পেয়েছি, একটা নির্মল জলের হ্রদ। যদিও ছোট তবুও
এখনকার মত তৃষ্ণা মিটে যাবে। চল যাই’। বলে সে সবাইকে নিয়ে সেখানে গিয়ে জল তোলপাড়
করে স্নান ও জলপান করল। তারপর থেকে তারা রোজই যায় সেখানে।
এদিকে হয়েছে কি, এই জলাশয়টার ধারে কতকগুলি খরগোস বাস করত। তারা তো ভয়ে জড়সড়।
না হবেই বা কেন? এই বড় বড় হাতির দল যদি আসে তারা যাবে কোথায়? হাতির পায়ের চাপে
অনেক খরগোসও মারা গেল।
তখন শিলীমুখ নামে একটা খরগোস সবাইকে ডেকে বলল, ‘রোজ যে হাতির দল এখানে আসছে
তাতে আমাদের তো বংশ নাশ হবে’।
বিজয় নামে একটি ঘরগোস বলল, ‘অস্থির হয়ো না। আমি এক প্রতিকার করছি’। বলে সে
তক্ষুনি যাত্রা করল হাতির দলপতির কাছে।
সে তো আর একটুখানি পথ নয়। ঘুরতে ঘুরতে সে পর্বতের চূড়ার কাছে গিয়ে দেখা পেল
দলপতির। দলপতি তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, র্তুই কে? কোত্থেকে এসেছ?’
বিজয় বলল, ‘ভগবান চন্দ্র আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার কাছে’।
‘কেন?’ দলপতি বলল।
‘আমি দূত’। বিজয় বলল, ‘জানেন তো—
উত্তোলিত শস্ত্রেও দূত অন্য কথা বলে না।
সর্বদা অবধ্য, নিশঙ্ক দূত প্রকৃত কথাই বলে।
আমি তাঁর আদেশ অনুসারেই বলছি। শুনুন, এই খরগোসের দল চন্দ্র সরোবরের রক্ষক।
তুমি তাদের বিতাড়িত করে ভাল কাজ করনি। এরা আমার রক্ষক শশক। তাই আমি শশাঙ্ক।
বিজয়ের কথা শুনে দলপতি গেল ভয় পেয়ে। বলল, ‘আজ্ঞে, আমি তা তো জানি না। যা করেছি
অজ্ঞতাবশেই করেছি। আর কখনও করব না’।
বিজয় বলল, ‘বেশ, তাই যদি হয় তবে সরোবরে অবস্থিত ভগবান চন্দ্রকে গিয়ে প্রণাম
জানিয়ে সন্তুষ্ট করে এস। আমি রাত্রিবেলা তোমাকে এসে নিয়ে যাব। তৈরি থেক’।
তারপর সেদিনই রাত্রিবেলা বিজয় করল কি, দলপতিকে নিয়ে সরোবরের মধ্যে চাঁদের
প্রতিবিম্ব দেখিয়ে বলল, ‘ঐ দেখ, তিনি রাগে কাঁপছেন। প্রণাম করে ক্ষমা চাও’।
দলপতি তো এমনিতেই ঘাবড়ে গিয়েছিল, এখন জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখে আরো ঘাবড়ে
গেল। সে তাড়াতাড়ি জলের কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি অজ্ঞানতাবশত অপরাধ করে
ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করুন। আর কখনও করব না’। বলেই সে ছুটে পালিয়ে গেল। খরগোসেরা
বিপদমুক্ত হল। তাই বলছিলাম কৌশলের কথা’।
বলে পাখি চুপ করলে আমি বললাম, ‘আমাদের প্রভু মহাপরাক্রমশালী। রাজ্যের কথা আর
কি বলব’।
‘কি?’ শুনেই তো পাখিরা চিৎকার করে উঠল। বলল ঃ ‘তুমি বড় উদ্ধত। তুমি আমাদের
দেশে কেন এসেছ? চল, তোমাকে আমাদের রাজার কাছে নিয়ে যাই’। বলেই তো তারা আমাকে রাজার
কাছে নিয়ে গেল।
আমাকে দেখেই রাজা জিজ্ঞেস করল, ‘এ কে? কোত্থেকে এসেছে?’
তারা বলল, ‘প্রভু, এ হিরণ্যগর্ভ নামক রাজহাঁসের অনুচর, কর্পুরদ্বীপ থেকে
এসেছে। সে আমাদের দেশে এসে আপনার নিন্দে করছে’।
মন্ত্রী শকুনি জিজ্ঞেস করল, ‘ওহে, তোমাদের প্রধানমন্ত্রী কে?’
‘আমি বললাম’—দীর্ঘমুখ বলতে লাগল, ‘সকল শাস্ত্রে পারদর্শী চক্রবাক আমাদের
প্রধানমন্ত্রী’।
শকুনি বলল, ‘হুম্। উপযুক্তই বটে। সে স্বদেশবাসী। কথায়ই তো আছেঃ
স্বদেশজাত, পবিত্রকুলাচার সম্পন্ন, ধর্মাচরণকারী, নির্মলচরিত্র, শাস্ত্রজ্ঞ,
দ্যুতক্রীড়াদিতে আসক্তিহীন, ব্যভিচার বর্জিত, ব্যবহার শাস্ত্রবেত্তা, বিখ্যাত,
সদ্বংশজাত, পণ্ডিত এবং ন্যায়ানুসারে অর্থউৎপাদনকারী গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকেই রাজা
মন্ত্রী নিযুক্ত করেন’।
শুকপাখি বলে উঠল, ‘মহারাজ, কর্পূরদ্বীপ প্রভৃতি জম্বুদ্বীপেরই অন্তর্গত।
সেখানেও তো আপনারই আধিপত্য’।
রাজা বলল, ‘হুম্। এরকমই বটে। কথায় আছে না—
রাজা, মাতাল, শিশু স্ত্রীলোক ও ধনগর্বিত ব্যক্তি এরা দুর্লভ বস্তু পেতে ইচ্ছে
করে। অনায়াসলব্ধ বস্তুর কথা আর কি বলব?’
‘আমি বললাম’—দীর্ঘমুখ বলতে লাগল, ‘কথা দিয়েই যদি কর্পুরদ্বীপে আপনার আধিপত্য
স্বীকৃত হয় তবে মহারাজ জম্বুদ্বীপে আমাদের মহারাজেরও আধিপত্য আছে’।
‘কি করে?’ শুক বলল।
‘কেন যুদ্ধ করে’। আমি বললাম।
রাজা হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার প্রভুকে গিয়ে বল তৈরি হতে’।
‘না মহারাজ, আমি কেন? দূত পাঠান’।
রাজা বললেন, ‘হুম, দূতই পাঠাব।
রাজভক্ত, বিশ্বাসী, গুণী, সৎচরিত্র, বাকপটু, কর্মনিপুণ, ক্ষমাশীল, ব্রাহ্মণ,
শত্রুর মনোভাব বুঝতে পারে এমন, প্রতিভাবান লোকই দূত হবেন’।
শকুনি বলল, ‘এমন লোক তো মহারাজ বহু আছেন, তবে’।
‘না, না, শুকই যাক’ বলে রাজা শুককে আদেশ দিল, ‘শুক তুমিই এর সঙ্গে গিয়ে আমাদের
কথা বল’।
‘মহারাজের আদেশ শিরোধার্য’। শুক বলল, ‘কিন্তু আমি এর সঙ্গে যাব না। কারণ ঃ
দুর্জন ব্যক্তির সঙ্গে বাস করা বা যাওয়া কখনই উচিত নয়।
কাকের সঙ্গে একত্র বাস করে হাঁস যেমন নিহত হয়েছিল, তেমনি দুর্জনের সঙ্গে যাওয়ায়’ ‘কি রকম?’ রাজা বলল। ‘তাহলে
শুনুন মহারাজ’। শুক বলতে লাগল ঃ
0 Reviews