রাজা শুদ্রকের

রাজা শুদ্রকের

Author:
Price:

Read more

বহুদিন আগে আমি যখন রাজা শুদ্রকের ক্রীড়াসরোবরে খেলা করতাম তখনই ঘটনাটা আমার কানে এসেছিল।
একদিন রাজা রাজসভায় বসে আছেন। কোন দেশের এক রাজপুত্র হঠাৎ রাজসভায় এসে রাজাকে অভিবাদন করে বলল, ‘মহারাজ, আমি এক কর্মপ্রার্থী। যদি আপনার কোন প্রয়োজন থাকে তবে দয়া করে আমায় রাখুন’।
রাজা বললেন, ‘রাখব তো, কিন্তু তুমি কি চাও?’
সেই রাজপুত্র বলল, ‘আজ্ঞে, আমার বেতন প্রতিদিন চারশ মুদ্রা’।
রাজা কি ভেবে বললেন, ‘এত বেতন যে চাও, তা তোমার অস্ত্র কি, আর তোমার নামই বা কি?’
রাজপুত্র বলল, ‘আজ্ঞে, আমার নাম বীরবর। আমার অস্ত্র হল’—বলে সে তার হাত দুখানি ও তার কোমরের তলোয়ার দেখিয়ে বলল, ‘আমার এই হাত দুটি ও এই তলোয়ার’।
রাজা বললেন, ‘এই তোমার অস্ত্র, আর তুমি চাও প্রতিদিন চারশ মুদ্রা?’ বলে তিনি মাথা নাড়লেন। ‘না, আমি সমর্থ নই’।
‘আচ্ছা মহারাজ’। বলে বীরবর মাথা নুইয়ে অভিবাদন করে বেরিয়ে গেল।
মন্ত্রীরা রাজাকে বললেন, ‘মহারাজ, একে বরং চারদিনের জন্য রেখে তার স্বভাব জানুন। তারপর উপযুক্ত বেতনের ব্যবস্থা করবেন’।
রাজা তখন তাকে ডেকে তার হাতে পান দিয়ে তাকে নিযুক্ত করলেন। পান কেন দিলেন জানেন তো—
তাম্বুল (অর্থাৎ পান) কটু, তিক্ত রসযুক্ত মধুর, ক্ষার ও কষায় রসযু্ক্ত, বাত উপশমকারী, শ্লেষ্মা ও কৃমিনাশক, দুর্গন্ধ নাশক, অধররঞ্জক, মলদোষ নাশক, কামোদ্দীপক ও ক্ষুধাবর্ধক। হে বন্ধু, তাম্বুলের এই তেরটি গুণ স্বর্গেও দুর্লভ।
যাহোক বীরবর তো কাজে লেগে গেল, কিন্তু রাজা লক্ষ্য করতে লাগলেন, বীরবর টাকাটা কি ভাবে খরচ করে। রাজা তার ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলেন। দেখেন কি, বীরবর রোজ যে চারশ মুদ্রা পায় তার অর্ধেক অর্থ সে দেবতা ও ব্রাহ্মণদের দান করে। বাকি অর্ধেকের অর্ধেক মুদ্রা দরিদ্রদের দেয়, আর বাকি অর্ধেক নিজের ভরণপোষণের জন্য রাখে। তারপর প্রাত্যহিক কাজ শেষ করে তলোয়ার নিয়ে রাজপ্রাসাদে গিয়ে প্রহরীর কাজ করে। সমস্ত দিন কাজ করে রাজা আদেশ করলে বাড়ি ফিরে যায়।
এভাবেই চলছিল দিন। হঠাৎ একদিন এক কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রাত্রিবেলা রাজা শোনেন, কে একজন স্ত্রীলোক করুণ সুরে বিলাপ করে কাঁদছে। রাজা তক্ষুণি বীরবরকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘বীরবর, কে কাঁদছে খবর নাও দেখি’।
‘যথা আজ্ঞা মহারাজ’। বলে বীরবর তক্ষুণী ছুটে বেরিয়ে গেল।
বীরবরও চলে গেছে, হঠাৎ রাজার মনে হল, রাত্রে বীরবরকে একা পাঠালাম, কাজটা ভাল হল না তো? না, আমাকে গিয়ে দেখতে হচ্ছে।
তারপর রাজাও একটা তলোয়ার নিয়ে চললেন বীরবরের পেছন পেছন। বীরবর কিন্তু টেরও পেল না। সে যেতে যেতে নগরের বাইরে গিয়ে দেখে, অপূর্ব রূপময়ী অলঙ্কারে ভূষিতা এক নারী এক জায়গায় বসে কেঁদেই চলেছে।
বীরবর গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, আপনি কে? কাঁদছেনই বা কেন?’
রূপসী বললেন, ‘আমি এ রাজ্যের রাজা শূদ্রকের রাজলক্ষ্মী। আমি বহুদিন এখানে ছিলাম, কিন্তু আজ থেকে  তিনদিনের মধ্যে রাজা মারা যাবেন। তাই আমি আর থেকে কি করব? তাই কাঁদছি’।
বীরবর বলল, ‘এর প্রতিকারের কি কোন উপায় নেই মা?’
রাজলক্ষ্মী বললেন, ‘উপায় থাকবে না কেন? কিন্তু তুমি কি তা পারবে? বত্রিশ লক্ষণযুক্ত তোমার পুত্র শক্তিধরকে যদি ভগবতী সর্বমঙ্গলা দেবীর নিকট বলি দিতে পার তবে রাজা একশ বছর বাঁচবে, আর আমিও থাকব’। বলেই তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
বীরবর কি আর তারপর দেরি করে? সে তক্ষুনি বাড়ি গিয়ে তার স্ত্রী ও ছেলেকে জাগিয়ে সব কথা বলল। তার ছেলে তো তক্ষুনি উঠে বলল, ‘বাবা, চলুন। আর দেরি করছেন কেন? এমন সুযোগ কি আর আসবে? আপনি তো জানেন—
প্রাজ্ঞ-ব্যক্তি ধন ও জীবন পরার্থে দান করেন। মৃত্যু যখন নিশ্চিত তখন তা সৎসাজে দান করাই শ্রেয়।
তার স্ত্রী বলল, ‘প্রভু, এ যদি না করা হয়, তবে রাজার দেওয়া বেতনই তো পরিশোধ হবে না’।
‘তাহলে চল’। বলে বীরবর সবাইকে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে দেবী সর্বমঙ্গলার পূজা করে বলল, ‘দেবী প্রসন্ন হন, রাজার জয় হোক’। বলেই সে তার নিজের ছেলের শিরচ্ছেদ করল। তারপর সে ভাবল, রাজার বেতন তো পরিশোধ হল, কিন্তু পুত্রহীন জীবন তো বৃথা। বলে তক্ষুনি নিজের গলায় তরবারি বসিয়ে দিল। হায়, হায় করে উঠল তার স্ত্রী। কিন্তু সে-ও তখন স্বামী-পুত্র ছাড়া জীবন বৃথা বলে তরবারী নিয়ে বসিয়ে দিল তার গলায়।
রাজা তো এসব দেখেশুনে অবাক। এমন লোকও পৃথিবীতে আছে। ভাবলেন –
আমার মত ক্ষুদ্র প্রাণী জন্মায় ও মরে, কিন্তু এর মত লোক অতীতে জন্মায়নি ভবিষ্যতেও জন্মাবে না।
তাহলে আমার জীবন রেখে লাভ কি? রাজ্যেরও কি প্রয়োজন? এই বলে তিনিও তরবারী নিজের গলায় বসাতে যাবেন দেবী সর্বমঙ্গলা তার সামনে আর্বিভূতা হয়ে বললেন, ‘ক্ষান্ত হও বৎস। আমি তোমার সাহসে মুগ্ধ হয়েছি। বল, তুমি কি চাও?’
‘মা, মাগো’। রাজা সাষ্টাঙ্গে দেবীকে প্রণাম করে বললেন, ‘আমি ধন চাই না, রাজ্য চাই না। যদি তুমি আমার উপর সন্তুষ্ট হয়ে থাক তবে স্ত্রীপুত্র সহ এই বীরবরের প্রাণ দান কর’।
দেবী বললেন, ‘ভৃত্যের প্রতি তোমার এই ঔদার্যে আমি খুব খুশি হয়েছি। যাও, তুমি বিজয়ী হও’। বলে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
বীরবর তারপর স্ত্রীপুত্রের সঙ্গে প্রাণ পেয়ে বাড়ি চলে গেল। আর রাজাও অলক্ষিতে চলে গেলেন প্রাসাদে।
তার পরদিন রাজপ্রাসাদে গিয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করে বীরবর বলল, ‘মহারাজ, আপনার আদেশে ছুটে গিয়ে কিছুই দেখতে পোলাম না’।
রাজা তার উপল সন্তুষ্ট হয়ে ভাবলেন, এ তো নিজের প্রশংসা করছে না। বুঝলেন—
অকৃপণ বলে মধুর খাদ্য, বীর নিজের প্রশংসা করে না, দাতা সৎপাত্রে দান করে এবং সাহসী হয় দয়ালু—
অতএব, ‘মন্ত্রী’ রাজা বলতে লাগলেন, ‘আগন্তুক মাত্রই কি দুষ্ট হয়?’
চক্রবাক, বলল, মহারাজ –
রাজাকে তোষণ করবার জন্য যে মন্ত্রী অ-কাজকে কাজ বলে উপদেশ দেয় সে নিন্দনীয় মন্ত্রী। রাজার মনে দুঃখ দেওয়া বরং শ্রেয়, অ-কাজ করে তার নাশ করা উচিত নয়।
যে রাজার চিকিৎসক, গুরু এবং মন্ত্রী প্রভুর চিত্তবিনোদনের জন্য প্রিয় বাক্য বলে, সে রাজা শ্রীঘ্রই শরীর, ধর্ম ও ধন হতে বিচ্যুত হন।
তাই বলছিলাম—
পুণ্যবশত একজন যা লাভ করেছে তা আমারও লাভ হবে এই লোভে ধনাকাঙ্ক্ষী এক নাপিত এক ভিক্ষুককে হত্যা করে নিজে নিহত হয়েছিল।
রাজা বললেন ‘কি রকম?’
‘তাহলে শুনুন’। চিত্রবাক বলতে লাগল ঃ

0 Reviews