বৈদিক যুগের কথা

বৈদিক যুগের কথা

Author:
Price:

Read more

বৈদিক যুগের কথা—

--এক--

তখন চীন ও মিশর ছাড়া সভ্যতার সূর্যদয় হয়নি আর কোন দেশে।
বিদেহ নামে এক রাজ্য ছিল আর্যবর্তে, আর তার রাজা ছিলেন জনক। মস্ত বড় জ্ঞানী ছিলেন তিনি, তাই লোকে তাঁকে রাজর্ষি বলতো।
জনকরাজা যজ্ঞ্য করছিলেন। অনেক দেশ-বিখ্যাত পণ্ডিত এসেছিলেন সেই সভায়। এই সব সমবেত ঋষিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে তাই জানার জন্য জনকের ভারী কৌতুহল হোল। যজ্ঞশেষে তিনি এক হাজার গাভী এনে ঋষিদের প্রণাম করে জানালেন—আপনাদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ তিনি দয়া করে আমার এই সহস্র গাভী গ্রহণ করুন।
কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। এই সভার মাঝে কে সাহস করে বলবে—আমি শ্রেষ্ঠ।
সহসা যাজ্ঞবল্কের কণ্ঠ শোনা গেল, তিনি তাঁর ব্রহ্মচারী শিষ্যকে আদেশ দিলেন – গরুগুলিকে আশ্রমে নিয়ে যাও।
ঋষিরা চমকে উঠলেন, বললেন – যাজ্ঞবল্ক্য, তুমিই কি আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাকি?
--সে স্পর্দ্ধা আমার নেই। শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের চরণে আমি প্রণাম করি, গরুগুলি আমার দরকার ছিল মাত্র।
--দরকার ছিল সকলেরই। আগে আমাদের প্রশ্নর উত্তর দাও, তারপর ওই দান গ্রহণের কথা।
যাজ্ঞবল্ক্য হাসলেন।
তারপর শুরু হোল প্রশ্নবান। হোতা অশ্বল, আর্তভাগ, ভুজ্যু উষন্ত, কহোল, একে একে সবাই পরাজয় মানলেন। তারপর উঠলেন বচক্‌নু ঋষির  মেয়ে, গার্গী। বেদশাস্ত্রের প্রশ্ন উঠলো, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়ে এসে সহসা যাজ্ঞবল্ক নির্বাক হয়ে গেলেন, বললেন—সাবধান গার্গী, আর প্রশ্ন করো না, বেদের নিয়ম তুমি লঙ্ঘন করছ, তোমার মুণ্ড খসে পড়বে।
ভয় পেয়ে গার্গীর মুখ বন্ধ হোল।
তারপর উঠলেন উদ্দালক। তিনি বসতেই গার্গী আবার উঠলেন, যাজ্ঞবল্ক্যের সামনে দ্বিতীয়বার উঠে দাঁড়ানোর সাহস আর কারুরই হয়নি। তবে গার্গী ছিলেন অসামান্যা বেদজ্ঞানী। ব্রাহ্মণ-সভাকে বন্দনা করে তিনি বললেন—আপনারা অনুমতি দিলে যাজ্ঞবল্ক্যকে আমি আরো দু’টি প্রশ্ন করবো। তার উত্তর দিতে পারলে বোঝা যাবে যাজ্ঞবল্ক্যই আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
ব্রাহ্মণেরা অনুমতি দিলেন, গার্গী প্রশ্ন করলেন – যাজ্ঞবল্ক্য, যা এই দ্যুলোক ও ভুলোকের মধ্যে, যা অতীত, যা বর্তমান, যা ভবিষ্যৎ রূপে বিদ্যমান, তা কিসে ওতঃপ্রোত আছে?
--আকাশে।
--সাধু, আচ্ছা, এই আকাশ কিসে ওতঃপ্রোত আছে?
--যাঁকে কেউ দেখতে পায় না কিন্তু তিনি সব কিছুই দেখতে পান যাঁকে কেউ শুনতে পান না কিন্তু তিনি সবই শুনতে পান, যাঁকে কেউ জানতে পারে না কিন্তু তিনি সবই জানতে পারেন, সেই অক্ষয় পুরুষেই আকাশ ওতঃপ্রোত আছে।
এইখানেই জ্ঞানের শেষ। গার্গী পরাজয় মেনে বললেন—যাজ্ঞবল্ক্য, তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ, আমাদের মধ্যে আর কেউ নেই যিনি তোমাকে জয় করতে পারেন।
হোলও তাই, ঋষি বিদগ্ধ উঠলেন, কিন্তু ধৃষ্টতা প্রকাশের জন্য যাজ্ঞবল্ক্যের শাপে তাঁর প্রাণ গেল। তারপর যাজ্ঞবল্ক্য সমবেত ব্রাহ্মণদের প্রশ্ন করলেন – একে একে সাতটি প্রশ্ন।
কিন্তু উত্তর দিতে পারলেন না কেউই।
যাজ্ঞবল্ক্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হোল, আর তাঁরই পরে স্থান পেলেন গার্গীর মত জ্ঞানী তখন আর তৃতীয় জন ছিল না। পাঁচ হাজার বছর আগেও মেয়েরা এমনি শিক্ষিতা হতেন এদেশে।
--দুই--

একদিন সকালে যাজ্ঞবল্ক্যের চোখে পড়তো তাঁর জটায় পাক ধরেছে। ঋষি বুঝলেন—ব্রহ্মচর্য শেষ করেছেন, গার্হস্থ্যও শেষ হোল, এবার সন্নাস। স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে ডেকে বললেন—মৈত্রেয়ী, আমি তো বনে চললাম, তুমি আর কাত্যায়নী রইলে আশ্রমে, বিত্ত সম্পত্তি যা আছে সবই তোমাদের মাঝে ভাগ করে দিয়ে যাই, নইলে হয়তো কোনদিন বিবাদের সূচনা হবে।
কাত্যায়নী যাজ্ঞবল্ক্যের আরেক স্ত্রী।
মৈত্রেয়ী বললেন—বিত্ত ও সম্পত্তির জন্য বিবাদ ঘটবে কেন? সম্পত্তির মাঝে কি সত্যিকারের আনন্দ পাওয়া যায়? অমৃতত্ত্ব পাওয়া যায়?
--না, তা পাওয়া যায় না।
--যা দিয়ে অমৃতত্ত্ব পাওয়া যায় না, তা নিয়ে আমি কি করবো? বিত্ত ও সম্পদ আমার চাই না, আপনি আমায় অমৃতের সন্ধান দিন।
--বেশ, বস, আমি তোমাকে সেই কথাই বলি—
যাজ্ঞবল্ক্য ব্রহ্মজ্ঞানের কথা বলতে শুরু করলেন – আত্মাকে দেখতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে, শুনতে হবে, বিচার করতে হবে, ধ্যান করতে হবে, তাহলেই তাকে জানা যাবে। আত্মাকে জানলে বিশ্বকে জানা যাবে। আত্মাই সব। এই পৃথিবীর প্রতিটি জীব, প্রতিটি বস্তু আত্মময়। স্বপ্নে ও জাগরণে আমরা যা কিছু দেখি, অনুভব করি তা সবই চৈতন্য, সবই আত্মা। এই আত্মা থেকেই যত বিদ্যা, জ্ঞান, শাস্ত্র ও শিক্ষার সৃষ্টি হয়েছে, প্রলয়কালে এই সব সৃষ্টি আবার সেই আত্মার মাঝেই লয় পাবে।
মৈত্রয়ী আত্মজ্ঞান লাভ করলেন। সামান্য সম্পদের ভাগাভাগির দিকে তখন আর তাঁর মন রইল না, মানব জীবনের সর্বস্ব যে জ্ঞান, সেই জ্ঞান চর্চায় তিনি মগ্ন হলেন।
মৈত্রেয়ী ব্রহ্মবাদিনী হিসাবে পরবর্তী কালে বিশেষ প্রসিদ্ধা হন।
অতো প্রাচীন কালেও ভারতের মেয়েরা জ্ঞানকেই সত্যিকারের সম্পদ বলে মনে করতেন—তাই ছিল আদর্শ। বিত্তের চেয়ে বিদ্যার মূল্য হোত বেশী।

--তিন—

মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। রাজা স্বয়ভূব মনু জিজ্ঞাসা করলেন – মা, কাকে তোমার পছন্দ হয়?
 তখনকার দিনে মেয়েরা স্বয়ম্বরা হোত। রাজকন্যা দেবহুতি বললেন – তেমন কোন রাজপুত্র তো দেখছি না, বাবা।
--রাজপুত্র ছাড়া অন্য কোন পাত্র?
--তাহলে কর্দম ঋষি....
মনু তখনই চললেন কর্দম ঋষির কাছে। কর্দম অল্পবয়সেই পাণ্ডিত্যে বিশেষ খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বিদ্যার অভিমান তাঁর ছিল না, মনুর অনুরোধ তিনি রক্ষা করলেন।
রাজার মেয়ে দেবহুতির সাথে আশ্রমবাসী সন্ন্যাসী কর্দমের বিয়ে হয়ে গেল। রাজপ্রাসদের বিলাস ছেড়ে রাজকন্যা স্বেচ্ছায় স্বামীর তপোবনে গিয়ে উঠলেন।
কথা উঠলো --  নির্জন অরণ্যে রাজকন্যার কত না কষ্ট হবে।
দেবহুতি বলেলেন – রাজার মত ঐশ্বর্যের আকাঙ্খা থাকলে কোন রাজপুত্রকেই বিয়ে করতাম, কিন্তু তাতো আমি চাই না। আমি চাই জ্ঞান, জ্ঞানচর্চার জন্য অরণ্যের নির্জনতাই শ্রেষ্ঠ। সেইজন্যই আমি ঋষির আশ্রমকেই পছন্দ করেছি।
দেবহুতি ছেলেবেলা থেকেই বিদ্যাচর্চায় বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। নির্জন তপোবনে স্বামীর পাশে বসে জ্ঞানচর্চা চললো সমভাবেই। ভারতের মহীয়সী মহিলাদের মধ্যে তাঁর নামও যুক্ত হয়ে পড়লো অজানিতে। আশ্রমের কাজ আর স্বামীর সেবা করার পর যে অবসরটুকু তিনি পেতেন, তারই মাঝে চিন্তা ও অনুশীলনের দ্বারা এক নতুন ভাবধারার উন্মেষ হোল তাঁর চিত্তে। সেই ভাবধারাকে তিন পূর্ণতা দিতে না পারলেও তাঁর পুত্র তাকে পূর্ণতা দিল—সাংখ্যদর্শনে।
দেবহুতির পুত্র কপিলই এই দর্শনের জনক। মানুষের মনকে বিশ্লেষণ করে তিনিই প্রথম দুঃখের কারণ নির্ণয় করেন ও মুক্তির সন্ধান দেন তাঁর সাংখ্যাসূত্র-তত্ত্বমাসে।
কত রাজবংশ, কত সিংহাসন ভারতভূমির ধূলার মাঝে হারিয়ে গেছে, কিন্তু হাজার হাজার বছরের বিপ্লব ও মহাকালের আবর্তনকে উপেক্ষা করে বেঁচে আছেন কপিলের মা দেবহুতি। তাঁর উপলব্ধিই সত্য হয়েছে—সিংহাসনের সোনার চেয়েও পুঁথির পাতা ওজনে ভারী।



0 Reviews