Read more
বৈদেশিকী
সীমা
বারো-শো বছর আগের কথা।
ভারতীয় সভ্যতার সীমা তখন মহাচীনের প্রান্তে
গিয়ে পৌঁছেছে। সাগরে সাগরে গৈরিক পতাকা লাঞ্ছিত হিন্দু জাহাজ ঢেউয়ে মাথায় মাথায়
সভ্যতা ও গৌরবের গর্ব বহন করে চলেছে ভারত সাগরের দ্বীপ থেকে দীপান্তরে।
পূর্ব-এশিয়ার তখন হিন্দু-সভাতার একাধিপত্য।–
মালয়, সুমিত্রা, যবদ্বীপ প্রভৃতির বুকে
চম্পাপুর, ইন্দ্রপুর বিজয়-নগর, পাণ্ডুরংগ, বীরপুর, রাজপুর এখনি কত সমৃদ্ধ নগরী গড়ে
উঠেছিল।
যবদ্বীপেও ছিল এমনি এক হিন্দুরাজ্য। কলিঙ্গ
রাজ্যের প্রজারা যবদ্বীপের পার্বত্য অঞ্চলে এক উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। নিজেদের দেশের
নামে সেখানকার নাম দিয়েছিল ‘কলিঙ্গ’।
সপ্তম শতকে এই কলিঙ্গ রাজ্য সহসা রাজাহীন
হোল। রাজা মারা গেলেন, তাঁর ছেলেমেয়ে কেউ ছিল না। মন্ত্রীরা কাকে রাজা করবেন সেই
চিন্তা করছেন, কাউকেই পছন্দ হচ্ছে না, এদিকে গুপ্তচর খবর এনেছে প্রতিবেশী রাজ্য
কলিঙ্গ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। শীঘ্রই একটা কিছু করা প্রয়োজন।
এমন সময় একদিন রাজহস্তী পথে বেড়াতে বেড়াতে
সামনে এক সন্ন্যাসিনীকে দেখতে পয়ে, তাঁকে পিঠে তুলে নিয়ে রাজসভায় এসে দাঁড়ালো।
মন্ত্রীরা সহসা যেন অকূলে কূল খুঁজে পেলেন, বললেন—ওই সন্ন্যাসিনীকেই আমরা আমাদের
রাণী করবো, এই বিধাতার নির্দেশ।
সন্ন্যাসিনী বললেন—আমি ছেলেকে নিয়ে তীর্থ
পরিক্রমা করতে বেরিয়েছি, বড়-বুদ্ধের পূজা করে সাগর পথে ফিরে যাব, রাজকার্যের আমি
কিছুই বুঝি না।আপনারা আমাকে রেহাই দিন—অর্থ, বিলাস ও সিংহাসনে আমার কোন প্রয়োজন
নেই।
কিন্তু মন্ত্রীরা ছাড়লেন না, সন্ন্যাসিনীকেই
সিংহাসনে বসালেন।
সন্ন্যাসিনী, ঈশ্বরে সর্বস্ব সমর্পণ করে
যিনি পথে এসে নেমেছেন সিংহাসনের বিলাস, সম্রাজ্ঞীর দম্ভ তাঁকে গ্রাস করতে পারলো
না। গেরুয়া-পরা রাণী প্রজাদের মাঝে নেবে এলেন, বললেন—আমি তোমাদের রাণী নই, আমি
তোমাদের সেবিকা, আমি তোমাদের সন্ন্যাসী-মা।
যেখানে গরীবের ঘরে অন্ন নেই, যেখানে পঙ্গু
কাতরাচ্ছে, যেখানে অনাথার চোখের জল মুছিয়ে দেবার কেউ নেই, সেখানেই সন্ন্যাসী-মা’র
কল্যাণী-মূর্তি আবির্ভূত হয়। প্রজাদের মনের মাঝে রাণীর সিংহাসন পাতা হয়ে যায়,
শিশুরা দেখতে পেলে কাছে ছুটে আসে, কাপড়ের খুঁট ধরে ডাকে—সীমা।
রাণীকে তাদের ভয় নেই, রাণীর পিছনে শাস্ত্রীর
খড়গ নেই।
দেশে রাণীর শত্রু নেই।
প্রতিবেশী রাজা চঞ্চল হয়ে পড়লেন, মন্ত্রীদের
ডেকে বললেন—তাহলে কি কলিঙ্গ জয় করা হবে না?
মন্ত্রীরা পরামর্শ দিলেন—কেন হবে না মহারাজ,
কলিঙ্গ রাজ্যে একজন বিশ্বাসঘাতককে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে রীতিমত অর্থ দিলেই সে
রাণীর বিরুদ্ধে প্রজাদের উত্তেজিত করবে, একটা বিদ্রোহের সুর যেই শোনা যাবে, সেই
সময় আমরা আক্রমণ চালাবো। বড় যুদ্ধ কিছু হবে না, সন্ন্যাসীর রাজ্যের কোন লোভ নেই,
খুনোখুনি দেখলেই সে সরে দাঁড়াবে।
--কিন্তু কে যাবে বিশ্বাসঘাতক খুঁজতে, তাকেই
তো প্রজারা ধরিয়ে দেবে, সব কথাই তখন প্রকাশ হয়ে পড়বে।
--কেউ ধরা পড়বে না মহারাজ, আমরা সে ব্যবস্থা
করবো।
শত্রুরাজ্যের চর এক থলি সুবর্ণ মুদ্রা ফেলে
রাখলো কলিঙ্গের রাজপথে।
রাজপথ। কত লোক যায় আসে, থলিটা দেখে, কিন্তু
তুলে নেওয়া দূরের কথা, কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করে না, দিনের পর দিন কেটে যায়। চর
কাছেই থাকে, সোনার লোভে যে লোক থলিটি কুড়িয়ে নেবে তাকে দিয়েই কাজ আরম্ভ হবে।
সন্ন্যাসী-মা’র ছেলে রোজই পথ দিয়ে যায়,
টাকার থলিটি রোজই তার চোখে পড়ে। থলিটি অনেকদিন পথের মাঝে পড়ে আছে দেখে রাজকুমার
একদিন পা দিয়ে সরিয়ে দিলেন পথের পাশে।
কথাটা সন্ন্যাসী-মা’র কানে পৌঁছালো।
সন্ন্যাসী-মা বললেন-এ অন্যায়, অপরের জিনিষ স্পর্শ করে তুমি অন্যায় করেছ। এই ভাবেই
মানুষের মনে লোভ জাগে, লোভ থেকে আসে অপহরণের প্রবৃত্তি। তুমি আমার অযোগ্য সন্তান,
তোমার মৃত্যুই বাঞ্ছনীয়।
আমাতোরা বললেন—নির্দোষকে এতো বড় শাস্তি
দেওয়া চলে না মা।
রাণীমা বললেন—পরের সুবর্ণ স্পর্শ করাই পাপ,
তার প্রয়শ্চিত্ত করতে হবে, সুবর্ণের থলি লাথি মেরে সরিয়েছে, তার পা দু’খানি কেটে
ফেলা হোক্।
আমাতোরা বললেন—পা দু’খানি কেটে ফেলা
মৃত্যুদণ্ডেরই সমতুল্য, রক্তপাত থেকে রাজ কুমারের জীবন রক্ষা পাবে না।
সন্ন্যাসী মা বললেন-বেশ, তাহলে অন্ততঃ পায়ের
বুড়ো আঙ্গুল দুটি কেটে ফেলা হোক্।
রাণীমা আর কোন আপত্তিই শুনলেন না,
রাজকুমারকে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দুটি হারাতে হোল।
প্রজারা দেখলো রাণীমার কাছে নিজের সন্তান ও
সাধারণ প্রজার মাঝে বিচারের কোন তারতম্য নেই। সন্ন্যাসী-মা আরো প্রজা-প্রিয় হয়ে
উঠলেন।
তিন বছর থলিটা পড়ে রইল, শেষে শত্রু রাজার চর
হতাশ হয়ে চুপি চুপি থলিটী কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে গেল। রাজা সব শুনলেন, কলিঙ্গ জয়ের আশা
তাঁকে ছাড়তে হোল।
সী-মা কতদিন সেখানে রাজ্য করেছিলেন ইতিহাসে তার কোন হিসাব নেই। ওই টুকরো
কাহিনীটি শুধু ভারতীয় সভ্যতার সুদূর প্রসারী প্রকাশের এক রশ্মী-রেখা মাত্র। সাতশো
বছরের পাঠান-মাঘল। শাসন ও দু’শো বছরের বৃটিশ অনাচার ভারতের সেই গৌরবময় ঐতিহ্য
ক্রমশঃ ধ্বংস করেছে। স্বাধীন ভারতে কি আবার সেদিন আসবে?
নশো বছর আগের কথা।
সাগরের বুকে সশস্ত্র রক্ষীর পাহারায় জাহাজ
বোঝাই শত শত বন্দী। ‘চম্পা’র রাজাকে হারিয়ে রাজধানী লুঠ করে নরনারী নির্বিচারে
বিদেশী বিজয়ী রাজা সকলকেই বন্দী করে নিয়ে চলেছে। এঁদের মধ্যে ধনী-নির্ধন,
উুঁচু-নিচু—কোন ভেদ না করে, সকলকেই ক্রীতদাসের জীবন বরণ করে নিতে হবে। মৃত্যুর
পূর্ব মুহূর্ত অবধি বিদেশীদের সেবা করতে হবে।
শত শত দাঁড় সাগরের বুকে উঠছে ও নামছে।
শাস্ত্রীদের কোষবদ্ধ তলোয়ার ও বল্লমের শাণিত ফলার পানে তাকিয়ে বন্দী দল ম্লানমুখে
বসে আছে। ভাবছে তাদের কি ছিল আর কি হবে।
চীন সাগরের বুকের উপর দিয়ে জাহাজ চলেছে।
চম্পার রাণী এক পাশে ম্লান মুখে বসে আছেন—দ্বিতীয়
জয়সিংহ বর্মার রাণী গৌড়েন্দ্রলক্ষ্মী। আনাম সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধে রাজা নিহত
হয়েছেন, রাজধানী বিজয়নগর লুন্ঠিত হয়েছে। রাণী চলেছেন বন্দিনী হয়ে। মৃত্যু ছাড়া আজ
আর মুক্তি নেই।
চম্পা-রাজ্য ছিল ভারতের বাহিরে, হিন্দু
উপনিবেশ, হিন্দু-চীনের পশ্চিম অংশে সমগ্র চীন সাগরের তটভূমি জুড়ে যে পার্বত্যময়
অঞ্চল আছে সেই কানেই হিন্দুরা চম্পারাজ্যের পত্তন করেন। চম্পাপুর, ইন্দ্রপুর,
বিজয়নগর, পাণ্ডুরংগ, বীরপুর, রাজপুর প্রভৃতি বহু সমৃদ্ধিশালী নগরী ছিল এই রাজ্যে।
আজও সেখানে অসংখ্য দেবদেবীর মন্দরি সেই সমৃদ্ধির সাক্ষ্য দিচ্ছে।।
চম্পার পশ্চিম সীমান্ত ছিল আনাম রাজ্যের
সীমানা। দুই রাজ্যে মারামারি লেগেই থাকতো। সুযোগ পেলেই এক দেশের রাজা আরেক দেশের
উপর লাফিয়ে পড়তো। ১০৪৪ খৃষ্টাব্দে সম্রাট কাট্মো দ্বিতীয় জয়সিংহ-বর্মাকে নিহত করে
চম্পারাজ্য লুঠ করে। লুঠের মাল ও বন্দীদের নিয়ে কাট্মো দেশে ফিরছেন। বন্দিনীদের
মধ্যে রয়েছেন রাণী গৌড়েলক্ষ্মী—গৌড়ের রাজকন্যা। চম্পার রাজারা অনেক দূরে থাকলেও
মাতৃভূমির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন নি। জয়সিংহ-বর্মার সঙ্গে গৌড়রাজকন্যার বিয়ে
হয়েছিল। কিন্তু যে সুখ ও সমৃদ্ধির আশায় গৌড়রাজ এই বিদেশে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন, আজ
তা অস্তমিত। আজ রাজরাণী বন্দিনী ছাড়া কিছু না। লক্ষ্মী বসে বসে ভাবছেন, তাঁর মন
বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। গৌড়-বরেন্দ্রভূমির রাজকুমারী আনাম-রাজের বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
গৌড়-বরেন্দ্রভূমির রাজকুমারী আনাম-রাজের দাসী বৃত্তি করবে—একি শুধু তাঁরই অপমান,
সমগ্র বঙ্গদেশের অগৌরব।
জাহাজ চলে, রাণী ভাবেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রাজ-অন্তঃপুরের আর যে সব মহিলা সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের বললেন—অপমানের
চেয়ে মৃত্যু ভাল, আমি মরবো।
তাঁরা বললেন—আমরাও মরবো, রাণী মা। যুদ্ধে
আমাদের স্বামীরা মরেছে, আমাদের সহমরণে যাবারই কথা, তা যখন পারিনি, তখন এখানেই
মরবো। মৃত্যুই এখন আমাদের কাছে দেবাদিদেব একেশ্বরলিঙ্গের আশীর্বাদ।
সেই রাত্রেই চম্পার মেয়েরা রক্ষীদের আক্রমণ
করলো। আনামীরা মেয়েদের হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখেনি। সন্ধ্যা থেকে মেয়েরা নিদ্রার
ভাণ করে পড়েছিল। রাত দুপুরে সবাই যখন নিদ্রামগ্ন হঠাৎ তখন অতর্কিতে মেয়েরা রক্ষী
ক’জনকে আক্রমণ করলো তাদের জলে ফেলে দিল, তারপর নিজেরাও জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
সারা জাহাজের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। গোলমালে
অনেকেই জেগে উঠেছিল, আগে আগে চলেছিল আনামী-রাজের ময়ুরপঙ্খী নাও, পিছনে আসছিল বিরাট
নৌবহর। সবাই বন্দিনীদের জাহাজটিকে ঘিরে ধরলো, সম্রাট জিজ্ঞাসা করলেন – কি হয়েছে?
সব শুনে তিনি নিস্তরঙ্গ সাগরের পানে
তাকালেন। রাত্রির অন্ধকারে নীল জল মখমলের মত পড়ে আছে,--স্থির অচঞ্চল। এতগুলি
বন্দিনী যে তার মাঝে হারিয়ে গেল সেজন্য কোথাও কোন বিক্ষোভ নেই।
জাহাজের মাথায় মাথায় হাজার হাজার মশাল জ্বলে
উঠলো। সাগরের বুকে তার রক্তিমাভা জাগলো, কিন্তু মানুষ দেখা গেল না। রাজা খানিকক্ষণ
সেই জলের পানে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন, সেনাপতি বললেন—একবার খুঁজে দেখি।
সম্রাট বললেন—কাউকে খুঁজে দেখার দরকার নেই।
পরাধীনতার চেয়ে যাঁরা মৃত্যু শ্রেয় মনে করেন, তাঁদের শান্তিতে মরতে দাও। গৌড়ের
রাজকুমারীকে আমি প্রণাম করি।
একটা দম্কা হাওয়া ঝড়ের পূর্বাভাস জানিয়ে
গেল। সম্রাট আদেশ দিলেন এগিয়ে চল।
মশালগুলো নিভেয়ে দেওয়া হোল। চারিপাশের কালো
আবরণ ঠেলে জাহাজগুলো এগিয়ে চললো। শুধু দাঁড়ের শব্দ, আর এক একটি আলোর সারি।
ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী
জুলাই, উনিশ শো তেতাল্লিশ।
বিরাট বাহিনী দাঁড়িয়েছে সোনানের মাঠে, হাজার
হাজার হিন্দু মুসলমান শিখ আজ ভারতভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়তে দাঁড়িয়েছে—ভারতের
মুক্তি—ফৌজ।
নেতাজী বলেছেন-আর বিলম্ব করার সময় নেই।
ইংরাজ শাসনের নাগপাশ থেকে ভারত উদ্ধারের শুভ সময় আজ এসেছে। হয় স্বাধীনতা, না হয়
মৃত্যু—এর মাঝামাঝি আজ আর কোন পথ নেই। জয় হিন্দ।
--জয় হিন্দ্। --লক্ষ কন্ঠে প্রতিধ্বনি ওঠে
চারিপাশে। বিদ্যুতের স্পর্শ লাগে বাতাসে। জনতার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে মেয়ের দল,
একটির পর একটি এগিয়ে আসে নেতাজীর সামনে, বলে—নেতাজী ওরাই শুধু লড়বে? হিন্দুস্থানের
মেয়েরা কিছু করবে না? পুরুষের পাশে বন্দুক ধরে আমরাও দাঁড়াবো।
নেতাজীর দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বললেন—ভারতের
বীর-বালারা যুগে যুগে পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়েছে, সেই ইতিহ্যের তোমরাই যোগ্যতম
উত্তরাধিকারিণী। তোমরা পূর্ব-এশিয়ার মুক্তি আন্দোলনে এক স্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি
করবে। ভারত-মায়ের বীর মেয়েরা, এগিয়ে এসো, হিন্দুস্থানের স্বাধীনতার স্বপ্নকে
সার্থক করে তোল।
শত শত মেয়ে এসে নাম লেখালো—ভারতীয়
যোদ্ধাবাহিনী গঠিত হোল ভারতভূমি থেকে চৌদ্দশত মাইল দূরে সিংহলের ময়দানে। ভারতের
শেষ স্বাধীন রাণীর পূণ্যস্মৃতিকে স্মরণ করে নেতাজী তাদেনর নাম দিলেন –ঝাঁসীর রাণী
রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথস্ হলেন দলের অধিনায়িকা।
নেতাজী বললেন—ভারতের পূর্ব সীমান্তে আমাদের
রণভেরী শীগ্গীর বেজে উঠবে। আমাদের গর্ব যে ভারতের মেয়েরাও এই স্বাধীনতার যুদ্ধে
যোগ দিয়েছে। দিল্লীতে যেদিন আমাদের জাতীয় পতাকা উড়বে, ভারতীয় মুক্তি ফৌজ লাল
কিল্লার ভিতরে কুচ্কাওয়াজ করবে, সেদিন আমাদের যুদ্ধ শেষ ...
অধিনায়িকা নেতাজীকে অভিবাদন জানায়, মেয়ের দল
মার্চ করে এগিয়ে যায়, পিছনে ব্যাণ্ড বাজে, তাতে নতুন সুর ঃ
--চলো দিল্লী পুকারকে
কৌমী নিশান সাম্হালকে
লালা কিল্লে পৈ গাড়কে
লহরায়ে জা লহরায়ে জা—
--ততর ততর ততর তর
তা তা তা তরর তরর...
বেলা দত্ত
--বুম্ বুম্ বুমা বুম্ বুম্।
দূর থেকে বোমার বিস্ফোরণ ক্রমশঃ কাছে আসছে,
গুর গুর করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বোমারু বিমানগুলি।
নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য
সুস্থ সবল মানুষগুলি দূরে সরে গেছে, যেখানে যেটুকু আশ্রয় পেয়েছে, যেখানে এতটুকু
নিরাপদ বলে মনে হয়েছে সেইখানেই মাথা বাঁচিয়েছে, চারিপাশটা নিমেষ মধ্যে আত্মময় হয়ে
উঠেছে।
প্লেনগুলি বারবার মাথার উপর আসার আগেই
চারিপাশ জনশূন্য হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি দাঁড়িয়ে দেখছে। মুখে তার মৃদু হাসি।
কে একজন বললো—তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছ কি, চলো—
--না
--না মানে?
--আমি গেলে চলবে কেমন করে, এদের দেখবে কে?
পঁচাশী জন আহত পড়ে আছে সারি সারি, সামরিক
হাসপাতালে, মেয়েটি একজন নার্স মাত্র।
তবু প্রশ্নকারী প্রশ্ন তোলে—কিন্তু...
--মনুষ্যত্ব মৃত্যুর চেয়েও বড়, বন্ধু—বলে
মেয়েটি হাসে।
প্রশ্নকারী আর সেখানে দাঁড়ায় না।
গুর গুর গুর গুর ... বুম বুম বুমা বুম...
চারিপাশে মাটি কাঁপতে থাকে। আহতেরা চমকে ওঠে
নার্স ভাববার সময় পায় না, কারুর মুখের কাছে ধরে জলের পিয়ালা, কারুর মাথায় একবার
হাত বুলিয়ে দেয় সস্নেহে।
কেউ ডাকে-বহিন।
কেউ বলে-দিদি।
নার্স বলে কুছ্ ডর নেহি ভাই, ভয় কি?
নার্সের কণ্ঠকে ছাপিয়ে ওঠে বোমার বিস্ফোরণ,
আহতের আর্তনাদকে ছাপিয়ে ওঠে প্লেনের গর্জন। তবু মেয়েটি পঁচাশীজন আহতের পাশে পাশে
থাকে, ছায়ার মত অবিচলিতা, অদম্যা।
বুম্ম্।
কি হয় ভালো করে বোঝার আগেই সম্বিত হারিয়ে
যায়।
তারপর বোমা বর্ষণ শেষ হলে বন্ধুরা ধ্বংসস্তুপের
ভিতর থেকে তাকে উদ্ধার করে। সম্বিত ফিরে পেয়েই মেয়েটি বলে—আমি ঠিক আছি, আার
হাসপাতালের কে কেমন আছে, তাই বল?
বিছানায় তাঁকে ধরে রাখা যায় না, বলে আমি
নার্স, সেবা করাই আমার কাজ, এই যুদ্ধের দিনে কি আমার শুয়ে থাকলে চলে?
কে জান এই মেয়েটি ? –ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল নয়,
এডিথ ক্যাভেল নয়, ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর এক কনিষ্ঠ সদস্যা, ষোল বছরের এক বাঙালী
মেয়ে, কুমারী বেলা দত্ত।
0 Reviews