Read more
বৌদ্ধ যুগ
যশোধারা
--রাণী মা
ভিক্ষুণী হবেন। নগরমধ্যে কথাটা ছড়িয়ে পড়লো কালবৈশাখী ঝড়ের মত। সবাই সাড়া তুললো তা
হয় না, আমাদের তা’হলে দেখবে কে?
রাণী-মা মৃদু
হেসে বললেন–আমি কি দেখবো। দেখবেন ভগবান। তিনি আমায় ডাকছেন বাবা, আমাকে যেতে যে
হবেই।
রাণী-মা পথে
বেরিয়ে পড়লেন। বরাবর যাবেন বৈশালীতে, সেখান থেকে শ্রাবন্তি। তাঁর সাথে সাথে বেরিয়ে
পড়লো রাজবাড়ীর হাজার-খানেক মেয়ে, বললো—আপনি গেলে আমরাও যাব রাণী মা।
রাণীমার চোখে
ফুটে উঠলো করুণা, মুখে হাসি, বললেন—এসো—
রাণী-মা মেয়েদের
সাথে নগরের পথে পদব্রজে চললেন। প্রজারা বললো—আপনি যখন নেহাৎই যাবেন মা, রথ দি—
--আর তো আমি রাণী
নই বাবা, আমি ভিক্ষুণী, আমার আর বিলাসের প্রয়োজন কি।
--কিন্তু মা, পথ
চলার বড় কষ্ট—কত কাঁটা বিঁধবে...
--চলতে চলতেই
অভ্যাস হয়ে যাবে, বাবা।
--একি একটু আধটু
পথ মা, এখান থেকে বৈশালী যে পঁয়তাল্লিশ যোজন...
রাণীমা মৃদু হেসে
এগিয়ে চললেন শুধু।
প্রজাদের চোখ সজল
হয়ে উঠলো।
রাণীমা একদিন
বৈশালীতে পৌছলেন।
সেখানে
প্রব্রজ্যা নিয়ে শ্রাবন্তিতে গেলেন ভগবান বুদ্ধদেবকে প্রণাম করতে।
ইনি বুদ্ধ-পত্নী
যশোধারা, বুদ্ধ যুগের ‘সীতা’ ছিলেন ইনি।
আটাত্তর বছর বয়স
পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম প্রচার করে রাজগৃহে তিনি দেহরক্ষা করেন।
যুগে যুগে
ভারতভূমিতেই শুধু এমনি মহিয়সী রাণীর আবির্ভাব ঘটেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও তা
মেলে না।
সুপ্রিয়া
সুদত্ত ছিলেন
মস্ত ধনী, তাঁর মেয়ে সুপ্রিয়া। প্রচুর ছিল ঐশ্বর্য কিন্তু সেদিকে মেয়ের মন গেল না,
সাত বছরের মেয়ে হঠাৎ গোঁ ধরলো—সে মঠে গিয়ে থাকবে, ভিক্ষুণী হবে।
সাত বছরের মেয়ে,
বাবা মত দেবেন কেন, কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা, শেষে রাজী হতে হোল। গৌতমীর কাছে
সুপ্রিয়ার দীক্ষা হোল।
অল্প দিনেই
সুপ্রিয়া ‘অর্হতী’ হলেন।
সেই সময়
শ্রাবন্তিপুরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল, অন্নাভাবে উঠলো হাহাকার, রাজভাণ্ডারে এতো অর্থ
নেই যে, অন্য কোথাও থেকে খাদ্য কিনে প্রজাদের রক্ষা করে। তাহলে?
বুদ্ধদেব বললেন—কে
এই অন্নকষ্ট নিবারণ করবে?
ভিক্ষুণী
সুপ্রিয়া এগিয়ে এলেন, বললেন—
--‘নগরীতে অন্ন
বিলাবার
আমি আজি লইলাম
ভার’।
ধনীরা পর্যন্ত
বিস্মিত হোল, পিতা সুদত্তের আজ সে অর্থ নেই, কন্যার মত সর্বস্ব ত্যাগ করে সেও আজ
ভিক্ষু, তাহলে মেয়েটি পাগল হোল নাকি?
সুপ্রিয়া বললেন—
‘শুধু এই
ভিক্ষা-পাত্র আছে।
আমি দীন-হীন মেয়ে
অক্ষম সবার চেয়ে
তাই তোমাদের পাব
দয়া
প্রভু-আজ্ঞী হইবে
বিজয়া।
আমার ভাণ্ডার আছে
ভরে
তোমা সবাকার ঘরে
ঘরে।
তোমরা চাহিলে সবে
এ পাত্র অক্ষয়
হবে
ভিক্ষা অন্নে
বাঁচাব বসুধা—
মিটাইব
দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা’। (রবীন্দ্রনাথ)
ধনীর দ্বারে
দ্বারে ভিক্ষা করে সুপ্রিয়া সত্যই নগরবাসীর মুখে অন্ন জোগালেন। এক সাধারণ
ভিক্ষুণীর ঐকান্তিকতায় সারা দেশ রক্ষা পেল। আর তার সঙ্গে অমরত্ব পেল তাঁর নিষ্ঠা।
অম্বপালী
বৈশালীর এক
আমবাগানে বুদ্ধদেব ক’দিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছেন।
তাড়াতাড়ি বৈশালীর
রাজা এলেন লোকজন নিয়ে, রথ নিয়ে, বললেন—সুগত, চলুল আমার প্রাসাদে।
তথাগত বললেন—আমি
অম্বপালীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি।
--অম্বপালী?
বাইজী অম্বপালী?
--হ্যাঁ, এই
আমবাগান যার, সেই অম্বপালীর গৃহে আমরা নিমন্ত্রিত।
রাজার নিমন্ত্রণ
উপেক্ষা করে শাক্যমুনি এক নর্তকীর ঘরে যাবেন খেতে।–রাজার অহঙ্কারে আঘাত লাগে।
রাজকর্মচারীরা তখনই ছুটলো অম্বপালীর কাছে, বললো—তুমি তোমার নিমন্ত্রণ প্রত্যাহার
কর, শাক্যমুনিকে আমরা নিয়ে যাই প্রাসাদে।
অম্বপালী বললো—না।
--মহারাজ তোমাকে
সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা দেবেন।
--লক্ষ মুদ্রা
দিলেও না।
--বেশ তুমি যা
চাও...
--আমি কিছুই চাই
না, সমগ্র বৈশালী নগর আমাকে দান করলেও আমি তা করবো না।
--কিন্তু সামান্য
প্রজা হয়ে মহারাজের বিরাগভাজন হওয়া...
--ভগবান আমার
সহায়।
রাজার লোকেরা
গালি দিতে দিতে ফিরে গেল।
সশিষ্য
বুদ্ধদেবকে ভোজন করিয়ে অম্বপালী নিবেদন করলো—আমাক এই উদ্যান, আমার এই বাড়ী-ঘর,
আমার যা কিছু অর্থ ও অলঙ্কার আপনার চরণে সমর্পন করলাম।
অম্বপালী ছিল
বৈশালীর শ্রেষ্ঠ নর্তকী, অনেক ঐশ্বর্য সে অর্জন করেছিল। সমস্ত সংঘকে দিয়ে সে
ভিক্ষুণী হয়ে গেল। বুদ্ধদেব তাঁকে শিষ্য করে অনেক উপদেশ দিলেন। অম্বপালী অল্পদিনের
মধ্যেই বিশিষ্ট্য ভিক্ষুণী হিসাবে গণ্য হল। অনেক ধর্ম-উপদেশের গান রচনা করে তিনি
গাইতেন—সেই সম্পর্কে অম্বপালী বৌদ্ধদের মধ্যে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
পটাচারা
ভগবান বুদ্ধ তখন
শ্রাবন্তি নগরে এসেছেন। নগরের জনগনের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে, জনে জনে আসছে শ্রীমুখের
উপদেশ শুনতে, আত্ম বিসর্জন করছে শাক্যমুনির চরণ ছায়ায়।
এক পাগলী চলেছিল
পথ দিয়ে কখন কাঁদছে, কখন বা চিৎকার করছে, কত কি বকছে আবোল তাবোল। সামনের লোক
ত্রস্তে পথে ছেড়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ একদিন সামনে
পড়লো শাক্যমুনি, -- শান্ত সৌম্য মূর্তি, শুভ্র গৌর দেহ, চোখে অপার করুণা। পাগলী
থমকে দাঁড়ালো।
বুদ্ধদেব কাছে
এলেন, বললেন, --কেন এই শোক? মানুষ এখানে আসে দু’দিনের জন্য, তারপর চলে যায়। কোথা
থেকে আসে, কোথায় যায়, -- কিছুই তো আমরা জানি না, তা হলে মিছে কেঁদে মরি কেন?
পাগলী চুপ করে
শুনলো, তারপর বললো—আমার স্বামী গেছে, দুটি ছেলে গেছে, মা-বাপ-ভাই গেছে। আমার
আত্মীয় নেই, আশ্রয় নেই। চিত্তের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে চিরদিনের মত।
--যারা গেছে তারা
তো চলে গেছে—আসা যাওয়াই তো জীবের ধর্ম। তবে কেন এই শোক। যারা রইল তাদের সামনে যে
অনেক কাজ, তারা যে জনগণকে দেখাবে সত্যের আলো, দেবে মুক্তির সন্ধান।
--আমি দেব
মুক্তির সন্ধান?—পাগলীর চোখে বিস্ময় ফুটে উঠলো।
--যার বন্ধন নেই,
সেই তো দেবে মুক্তির সন্ধান। জীবনের সত্যরূপ তো তোমার কাছেই প্রতিভাত হয়েছে সবচেয়ে
বেশী।
কী ছিল সেই মুখের
বাণীতে, কী ছিল সেই চোখের দৃষ্টিতে জানি না, পাগলী আছড়ে পড়লো শাক্যমুনির চরণে।
পাগলামির মলিনতা
মুছে গিয়ে তার মুখে ফুটে উঠলো ধর্মের দীপ্তি। পাগলী ভিক্ষুণী পটাচারা নামে
প্রসিদ্ধি লাভ করলেন। দেশে দেশে তিনি ঘুরতে লাগলেন ভগবান বুদ্ধের মধুর বাণী প্রচার
করে। যেখানে দুঃখ, যেখানে শোক, সেখানেই তাঁর সান্ত্বনা শোনা গেল। তাঁর সেই উপদেশ,
শোকতুরদের চিত্ত এমনভাবে অভিভূত করতো যে, এক-একবারে পাঁচশো মহিলা বৌদ্ধধর্মে
দীক্ষা নিত তাঁর কাছে।
ধর্মের অনেক গানও
পটাচার রচনা করেছিলেন। তাঁর ভিক্ষুণী শিষ্যরা সেইগুলি গেয়ে বেড়াতেন।
এমনিই ছিল
প্রাচীন ভারতের সভ্যতার রূপ। অনাথা পথের পাগলীও সে যুগে গুরুর আসনে বসার শিক্ষা ও
সুযোগ পেতো, আর আজকে?
সঙ্ঘমিত্রা
মহাদান-উৎসবের
দিন।
ভগবান বুদ্ধের
মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে মহারাজ আশোক ভারতভূমিতে চুরাশী হাজার বৌদ্ধ-বিহার তৈরী
করিয়েছেন। এই সববিহারের ভিক্ষুদের আজ তিনি দান করবেন, তাই আজ মহাদান উৎসব।
মহাজ্ঞানী
ভিক্ষু-শ্রেষ্ঠ মহাস্থবীর তীষ্য রাজসভায়এসেছেন, তিনি আসন পেয়েছেন রাজাসনেরও উপর। মহারাজ অশোক তাঁকে
জিজ্ঞাসা করলেন—ভগবান্, শ্রেষ্ঠ দান কি?
--নিজের পুত্র কন্যাকে ধর্মের
জন্য উৎসর্গ করাই শ্রেষ্ঠ দান। আর যিনি সেই দান করতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ দাতা।
মহারাজের পাশে বসেছিলেন কন্যা
সঙ্ঘমিত্রা আর পুত্র মহেন্দ্র সম্রাট তাঁদের পানে তাকালেন। সঙ্ঘমিত্রা এই শুভ
মুহূর্তটির প্রতীক্ষা করছিলেন, বললেন—মহারাজ, আপনার অনুমতি পেলে আমি ভিক্ষুণী হয়ে
দেশে দেশে সদধর্মের বাণী প্রচার করি—এই আমার চিরদিনের কামনা।
রাজকুমার মহেন্দ্র এসে দাঁড়ালেন
বোনের পাশে, বললেন—মহারাজা আমাকেও অনুমতি করুন।
সভার মাঝে সজল চোখে মহারাজ অশোক
পুত্র ও কন্যাকে তুলে দিলেন মহাস্থবিরের হাতে।
গেরুয়া বসনে রাজপুত্র ও রাজকন্যা
এসে দাঁড়ালেন মায়ের কাছে। মা সজল চোখে—সম্রাট শেষে তোমাদের রাজভোগে বঞ্চিত করলেন।
সঙ্ঘমিত্রা বললেন—না মা, রাজভোগে
আমার আকাঙ্ক্ষা নেই, তাই স্বেচ্ছায় এই পবিত্র ধর্মে দীক্ষা নিলাম, এ আমার আশৈশবের
স্বপ্ন।
তারপর শাস্ত্রপাঠ শেষ করে ভাইয়ের
হাত ধরে ভিক্ষুণী সঙ্ঘমিত্রা যাত্রা করলেন দিগ্বিজয়ে। ভিক্ষুণী সম্রাট-নন্দিনীকে
দেখার জন্য ভারতের প্রান্ত থেকে প্রান্তান্তরে সাড়া পড়ে গেল, পায়ের ধুলো নিয়ে ধন্য
মনে করলো নিজেকে।
কন্যাকুমারী থেকে ভাইবোন একদিন
এসে পৌঁছলেন সিংহল-তটে। সিংহল রাজ মৃগয়া করতে বেরিয়ে ছিলেন, বনের মাঝে অপরূপ
দেবমূর্তি দেখে তিনি বিস্মিত হলেন, বললেন—কে আপনারা?
--আমরা ভারতসম্রাটের ছেলেমেয়ে।
ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী। তলোয়ারের জেরে আপনার দেশ জয় করতে আসিনি, এসেছি ভগবান বুদ্ধের
অমর বাণী শুনিয়ে আপনাদের অন্তর জয় করতে।
সিংহল রাজ বিস্মিত হলেন, সারা
ভারত যাঁদের অস্ত্রের ঝঞ্জনায় কেঁপে উঠতে পারতো তারা কিনা সর্বহারা ভিক্ষু আর
ভিক্ষুণী। রাজা তাঁদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন প্রাসাদে। পুরমহিলারা সঙ্ঘমিত্রার
চারিপাশে ভীড় করলো, তাঁর মুখে অপূর্ব ধর্মকথা শুনে সকলে আত্মসমর্পণ করলো তাঁর
চরণে। সিংহল-রাজকুমারী অনুলা হলেন ভিক্ষুণী।
তারপর সারা সিংহল দীক্ষা নিল
বৌদ্ধধর্মে। রাজকুমারী অনুলা গয়া থেকে বোধিবৃক্ষের শাখা আনিয়ে প্রতিষ্ঠা করালেন
সিংহলে।
ভারত-সম্রাটের ভিক্ষুণী-মেয়ের
ত্যাগ ও আদর্শের কাছে একটি রাজ্য মাথা নত করলো। তেইশ-শো-বছর আগের সেই জ্ঞানভাস্বর
দিগ্বিজয়ের রেশটুকু আজও সিংহলবাসীরা সগৌরবে বহন করে চলেছে। সেই একটি মেয়ের গৌরব
আজও সারা ভারতের গৌরব।
মালিনী
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা।
কাশীর রাজা কৃকীর কাছে
ব্রাহ্মণেরা এসে নালিশ জানালেন—মহারাজ আপনার কন্যা ব্রাহ্মণ্যধর্মে অবজ্ঞা করে
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শরণ নিয়েছেন। কাশীধাম সনাতন হিন্দু-ধর্মের কেন্দ্র, আপনি তার নরেশ
এবং রক্ষক, আপনার কন্যার এই ধর্ম-বিরোধী আচার বড়ই বেদনাদায়ক।
তখনই রাজসভায় কন্যার ডাক পড়লো।
মহারাজ বললেন—মালিনী, তুমি
বৌদ্ধ-শাস্ত্র চর্চা করছ?
--হ্যাঁ পিতা।
--তুমি বৌদ্ধ ভিক্ষুদিগকে
রাজ-অন্তঃপুরে ডেকে নিয়ে গিয়ে অশাস্ত্রীয় ধর্ম আলোচনা কর?
--সত্য মহারাজ।
--পূর্বপুরুষের চিরাচরিত ধর্মের
প্রতি এইভাবে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা গুরুতর অপরাধ তা জান?
--শাস্ত্রচর্চায় সত্যানুসন্ধানে
কোন অপরাধ হয় না মহারাজ।
--স্তব্ধ হও, তোমার মত এক কিশোরীর
প্রগল্ভতা প্রকাশের স্থান রাজসভা নয়।
তারপর সুরু হোল আলোচনা, রাজনীতির
বিধান অনুযায়ী রাজা মালিনীর উপর চিরনির্বাসন দণ্ড দিলেন, বললেন—যা কিছু তোমার
প্রয়োজন, নিয়ে রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে।
মালিনী মোটেই বিচলিত হলেন না,
বললেন – আমার কিছুই প্রয়োজন নেই পিতা, আমার শুধু একটা শেষ মিনতি আছে—আমাকে আপনি
সাত দিন বক্তৃতা দেবার অনুমতি দিল। এই সমবেত ব্রাহ্মণমণ্ডলীর কাছে আমি আমার
অন্তরের কথা জানাতে চাই।
কাশীরাজ ব্রহ্মণপণ্ডিতদের মুখের
পানে তাকালেন। ব্রাহ্মণেরা সম্মতি দিলেন—যতই হোক রাজার মেয়ে, কি বলতে চায় শোনাই
যাক না, চিরদিনের মত যখন চলেই যাচ্ছে।
মঞ্চ প্রস্তুত হোল, রাজসভা
লোকারণ্য হোল, ষোল বছরের রাজকন্যা শুরু করলেন তাঁর বক্তৃতা—
বৌদ্ধধর্মের মর্মকথা—সদ্ধর্মের
তত্ত্বকথা সকলকে অভিভূত করে ফেললো। নতুন জ্ঞানের আলো ফুটে উঠলো সকলের চোখে।
সাতদিন পরে যখন গেরুয়া-পরা
রাজকন্যা সকলের কাছে বিদায় চাইলেন তখন ব্রহ্মণমণ্ডলী চঞ্চল হয়ে উঠলেন, দশ হাজার
নগরবাসী প্রণাম জানালো মালিনীর চরণে। রাজা বললেন—তুমি এ রাজ্যের কল্যাণী-লক্ষ্মী,
আমাদের পরিত্যাগ করে যাওয়া তোমার চলবে না মা।
--কিন্তু মায়ার বন্ধন থেকে আমি
মুক্ত হতে চাই পিতা, ভগবান বুদ্ধের বাণী প্রচার করাই আমার জীবনের ব্রত, আমি
ভিক্ষুণী।
--তুমি যদি একান্তই এখানে না
থাকতে চাও মা, সারনাথের নির্জনপ্রদেশে তুমি বাস করগে, যেন তোমাকে প্রয়োজনে আমরা
পাই।
মালিনী সারনাথে আশ্রয় নিলেন। নিজ
নিষ্ঠায় ভারতের শত শত মুক্তিকামী মহিলাকে আকৃষ্ট করলেন। সারনাথ ভারতের অন্যতম
ভিক্ষুনী-কেন্দ্র হয়ে উঠলো। নিজের সাধনা, স্বকীয়তা ও সত্যনিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ষোল
বছরের একটি মেয়ে সারা ভারতের মহিলাদের সামনে এক নতুন পথের আদর্শ তুলে ধরলেন।
রুক্মাবতী
দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। তারই
সাথে এসেছে অনাবৃষ্টি ও মহামারী। অনাহার আর আর্তনাদে দেশের আকাশ বাতাস ছেয়ে গেল,
পল্লীর মুখরতা শ্মশানের স্তব্ধতায় হারিয়ে গেল।
যারা বেঁচে আছে, তারা এখন যা পায়
তাই কায়,--ঘাস-পাতাও আর নেই।
ধনী বিদূষী রুক্মাবতী পথ দিয়ে
চলেছেন, হঠাৎ তাঁর চোখে পড়লো একটি রমণী একটি শিশুকে ধরে খাবার জোগাড় গরছে।
রুক্মাবতী শিউরে উঠলেন, সহসা নিজের দৃষ্টিকে তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না।
তাড়াতাড়ি রমণীটির কাছে এগিয়ে গেলেন—তুমি একি করছ।
রমণী কঙ্কালসার, ক্ষুধায় ধুঁকছে,
বললো—কি খাই বল? বাঁচতে হবে তো।
--তা’বলে ওই শিশুটিকে...?
রমণী বিকটভাবে হেসে উঠলো।
--বেশ, আমি যদি তোমাকে ভালো খাবার
দিই?
--তা’হলে ওকে খাব না।
--বেশ, তুমি তা’হলে দাঁড়াও, আমি
খাবার আনছি।
--কিন্তু বেশী দেরী করতে পারবো না
বাপু, আমার বড় খিদে পেয়েছে...
বাড়ী গিয়ে খাবার আনতে কিছু সময়
লাগবেই, ততক্ষণ রমণীটি অপেক্ষা করতে পারবে কি না কে জানে, রুক্মাবতী পারেক থমকে
দাঁড়ালেন, কি জেন ভাবলেন। ওই রাক্ষসী রমণীর কবল থেকে ছেলেটির প্রাণরক্ষা করতে হলে
এখনই কিছু করা দরকার। কিন্তু ওই রমণীকে কি দেবেন খেতে? সহসা একটা কথা তাঁর মনে
পড়লো। সহসা একটা কথা তাঁর মনে পড়লো। সঙ্গে ছিল একখানি ছোরা, তাই দিয়ে দুই স্তন
কেটে দিলেন সেই রাক্ষসী রমণীর হাতে, বললেন—এই নাও, শিশুটিকে দাও।
শিশুটির প্রাণ রক্ষা পেল।
সবাই এই অপূর্ব দানের কথা শুনে
রুক্মাবতীর বাড়ীতে এলো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তাঁর প্রশংসা করতে।
আত্ম-প্রশংসা শোনা পাপ, তাই একটু
সুস্থ হয়ে রুক্মাবতী নগর ছেড়ে অরণ্যে চলে গেলেন। তিনি ছিলেন বৌদ্ধশাস্ত্রে বিশেষ
বিদূষী। অরণ্যেই তাঁর চারিপাশে শত শত ভিক্ষুণী এসে সমবেত হলেন, এক বিরাট মহিলা মঠ
গড়ে উঠলো সেখানে।
কাশীসুন্দরী
বৌদ্ধযুগের কথা। তখন কাশীর রাজা
ছিলেন ব্রহ্মদত্ত। ব্রহ্মদত্তের এক মেয়ে ছিল, তাঁর নাম কাশীসুন্দরী।
অল্প বয়স থেকেই কাশীসুন্দরীর
পড়াশুনায় বিশেষ আগ্রহ ছিল। দেখতে দেখতে তিনি সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করে ফেললেন।
তারপর মহাত্মা কনকের কাছে গেলেন
যোগ শিখতে।
সেখান থেকে ভগবান কশ্যপের কাছে
গেলেন বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে।
জ্ঞানচর্চা চলছে, এদিকে কাশীরাজ
মেয়ের বিবাহের সব ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু কাশীসুন্দরী বিয়ে করতে রাজী নন, রাজাকে
একদিন বললেন-আমি চিরকুমারী থাকতে চাই পিতা, শাস্ত্রচার্চা করেই আমি জীবন কাটাবো
বলে ঠিক করেছি।
তখনকার দিনে মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে
এমন কোন কথা ছিল না, কাজেই কাশীরাজ বিশেষ কোন আপত্তি তুললেন না। কিন্তু মুস্কিল
হোল দেশ-বিদেশের রাজপুত্রদের নিয়ে, অমন সুন্দরী রাজকন্যা আর অর্দ্ধেক রাজত্বের লোভ
তারা সহজে ছাড়তে পারলো না, ভয় দেখিয়ে বললো—যদি রাজকন্যা আমাদের কাউকে না বিয়ে
করে,তা হলে মেয়েকে আমরা তলোয়ারের জোরে লুঠে নিয়ে যাব।
তখনকার দিনে কনে লুঠ করে নিয়ে
যাবার প্রথা ছিল, মহাভারতেও তার অনেক উদাহরণ আছে।
কাশীসুন্দরী তখন কশ্যপের আশ্রমে।
কশ্যপ ত্রস্ত হয়ে উঠলেন বললেন—আমার এই আশ্রমে রক্তপাত কেন? তুমি যা-হোক-একটা কিছু
ঠিক করে ফেল মা।
কাশীসুন্দরী বললেন—ঠিক তো করাই
আছে ভগবান্।
--সে ঠিক নয় মা, --সে ঠিক নয়,
এদের কাউকে বিবাহ করে রক্তপাত থেকে নিবৃত্ত কর।
--রক্তপাত হবে না ভগবান্, ওরা
আমাকে পেলে তবে তো লুঠ করে নিয়ে যাবে, কিন্তু ওরা আমাকে স্পর্শ করতেই পারবে না।
কথাটা রাজকুমারদের কানে যেতেই
তারা বললো—বটে।
তখনই রাজকুমারেরা সকলে কশ্যপ ঋষির
আশ্রমে এসে উপস্থিত হোল।
এদিকে কাশীসুন্দরীও যোগাসনে
বসলেন, যোগ-প্রক্রিয়ার ফলে দেখতে দেখতে মাটি ছেড়ে তিনি শূন্যে উঠলে লাগলেন।
রাজপুত্রেরা যখন তাঁকে ধরতে এলো তখন তিনি তাদের নাগালের উর্দ্ধে।
এতক্ষণে রাজকুমারেরা নিজেদের ভুল
বুঝতে পারলো, ত্রুটি স্বীকার করে কাশীসুন্দরীর চরণে প্রণাম জানিয়ে তারা বিদায়
নিলে। কাশীসুন্দরীও কশ্যপের কাচে ধর্মচর্চায় মনোনিবেশ করলেন।
এমনিই ছিল তখনকার মেয়েদের
ব্রহ্মতেজ আর জ্ঞানচর্চার ঐকান্তিকতা।
শ্রীমতী
বৈশাখী পূর্ণিমা।
ভগবান বুদ্ধদেবের জন্মতিথি।
কিন্তু রাজধানীতে আজ আর দীপাবলীর
শোভা নেই। উৎসবের আনন্দ নেই কোথাও। সমগ্র নগরী স্তব্ধ, বিষাদে আচ্ছন্ন।
সম্রাট বিম্বিসার ছিলেন তথাগতের
প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাবান, শাক্যমুনির নীতি ও করুণাকে চিরস্মরণীয় করে রাখাপ
উদ্দেশ্যে তিনি বিরাট স্তুপ তৈরী করিয়েছিলেন। রাজ্য মধ্যে প্রচার করেছিলেন সদ্ধর্মের
বাণী।
পুত্র অজাতশত্রু কিন্তু ধরলেন ঠিক
উল্টো পথ, আদেশ দিলেন বৌদ্ধনীতি চলবে না, চলবে না শাক্যমুনির পূজা।
বৌদ্ধেরা রাজ্য থেকে নির্বাসিত
হোল।
প্রজাপুঞ্জ রাজদণ্ডের ভয়ে নির্বাক
হয়ে গেল।
বৌদ্ধ রাজশক্তি শেষ অবধি
ধর্মনীতিকে জয় করতে পারলো না। পাজপ্রসাদের দাসী শ্রীমতী সবার আগে প্রতিবাদ জানালো
রাজ আদেশের বিরুদ্ধে।
প্রতি সন্ধ্যায় শ্রীমতী তাকিয়ে
থাকে স্তুপের পানে। কোথাও একটা দীপের শিখা চোখে পড়ে না। তার দু’চোখ জলে ভরে আসে সে
কেবল ভাবে।
বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে শ্রীমতী আর
চুপ করে থাকতে পারে না, রাজমাতার কাছে গিয়ে অনুমতি চায় – মা আজকেও স্তুপমূলে
প্রদীপ দেওয়া চলবে না?
রাজমাতা বললেন—না, না, প্রদীপ
দেওয়ার চেয়ে প্রাণের মূল্য অনেক বেশী।
শ্রীমতী রাণীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো,
সেখানেও সেই একই কথা—না, না।
শ্রীমতী রাজকন্যার কাছে যায়। সে
তো শিউরে ওঠে ভয়ে।
শ্রীমতী নাগরিকদের দ্বারে দ্বারে
গয়ে হাঁকে—ওগো, আজ যে তথাগতের জন্মতিথি।
নগরবাসীরা বলে—পাগলী।
শ্রীমতী তখন একাই স্তুপের মূলে
প্রদীপ জ্বেলে দেন। সন্ধ্যার অন্ধকার ভেদ করে প্রদীপশিখা কেঁপে কেঁপে ওঠে লোকের
চোখের আলোয়। সবাই বিস্ময় মানে।
প্রতিহারীরা শ্রীমতীকে ধরে আনলো।
শ্রীমতী বললেন—ভগবান তথাগতের আমি
পূজারিণী, কোন অপরাধ তো করিনি।
রাজা শ্রীমতীকে চরম দণ্ড দিলেন।
শ্রীমতী হাসিমুখে মৃত্যু বরণ
করলেন।
ইহাই বোধ হয় জগতের ইতিহাসে
রাজ-আদেশের বিরুদ্ধে প্রথম সত্যাগ্রহ।
0 Reviews