Read more
এক সারথি
শ্রীনগরে মন্দমতি নামে এক সারথি বাস করত। সে জানত, তার স্ত্রী, সে বাইরে চলে
গেলে, তার এক ছেলে-বন্ধুর সঙ্গে গল্পগুজব করে। সে শুনতই, কিন্তু কোনদিন ধরতে পারত
না।
একদিন সে বাইরে যাওয়ার নাম করে গোপনে ঘরে এসে খাটের নিচে বসে রইল। তার ভাগ্য
ভাল, সেদিনও তার স্ত্রীর ছেলে-বন্ধু এসেছে। তার স্ত্রী তো তাকে খাটে বসিয়ে
খাবার-দাবার নিয়ে গল্পগুজব করছে, সারথি শুনছে সব খাটের নিচে থেকে, আর রাগে ফুঁসছে।
সারথি নিজে খুবই বলশালী ছিল। ইচ্ছে করলে সে তখনি দুজনকে ধরে পেটাতে পারত। কিন্তু
সে তা না করে ভাবতে লাগল কি করা যায়।
এমন সময় তার স্ত্রী কি একটি হাসির কথা বলে পা দুলিয়ে হাসতে হাসতে হঠাত খাটের
নিচে বসে থাকা স্বামীর গায়ে পা লেগে যেতেই চমকে উঠল। বুদ্ধি তার কম ছিল না। সে
বুঝল, তার স্বামী বসে আছে খাটের নিচে। সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে চুপ করে গেল সে।
তার বন্ধুটি বলল, ‘কি চুপ করে আছ যে?’
সারথির স্ত্রী বলল, ‘না, চুপ করলাম কোথায়?’
ভাবলাম, আমার স্বামী আজ কখন কোন্ ভোরে বেরিয়ে গেছে। মানুষটার খাওয়া হল কি না
কে জানে? আমি হাসছি বটে, কিন্তু আমার মন পড়ে রয়েছে তার কাছে। তাকে ছাড়া আমার সবই
খারাপ লাগছে’।
তার কথা শুনে তার বন্ধু গেল রেগে। বলল, ‘তুমি তার কথাই যদি ভাব, তবে আমাকে কেন
বলেছিলে যে তোমার স্বামী কলহপ্রিয়?’
‘কি বলব?’ রেগে গেল সারথির স্ত্রী। বলল, ‘তুমি একটি মূর্খ, না হলে’—
বলাও শেষ করেনি সে, বলশালী সারথি ঝট করে লাফিয়ে উঠল খাটসুদ্ধ তাদের দুজনকে
মাথায় করেই। তার কি আনন্দ, তার স্ত্রী এত ভাল আর সে কিনা ঝগড়া করে তার স্ত্রীর
সঙ্গে? খাট মাথায় করে সে নাচতে লাগল। সারথির স্ত্রী আর তার বন্ধু তো থ। নামতেও
পারে না খাট থেকে, যেতেও পারে না। সারথি তো তখনও নেচেই চলেছে।
‘তাই বলছিলাম’—শুক বলতে লাগল, ‘মূর্খ চাটুবাক্যতেই তুষ্ট হয়’।
তারপর মহারাজ তাদের রাজা আমার প্রতি দূতের সম্মান দিলে আমিও তাকে যথাযোগ্য
সম্মান দেখিয়ে চলে এলাম। শুকপাখিও আমার পেছন পেছন আসতে লাগল। এখন যা করবার করুন
বলে দীর্ঘমুখ চুপ করল।
মন্ত্রী চক্রবাক হেসে বলল, ‘মহারাজ, এই বক নিজের সাধ্য অনুসারে অন্য দেশে
রাজকার্য করে এসেছে’। মূর্খদের স্বভাবই তো এই ঃ
পণ্ডিতের উপদেশ হল একশ মঙ্গলজনক কাজ উপেক্ষা করবে, তবু বিবাদ করবে না, আর বিনা
কারণে দ্বন্দ্ব হল মূর্খের লক্ষণ’।
রাজা বলল, ‘যাক্ যা হয়েছে তা তো হয়েইছে, তা নিয়ে আর তর্কের দরকার নেই। এখন
যুদ্ধের কারণ কি?’
চক্রবাক বলল, ‘নির্জনে বলব। কারণ ঃ
মুখরাগ, বহিরাকৃতি, স্বর, নয়নবিকৃতি, মুখবিকৃতি, মনোভাব জ্ঞানীরা তর্কদ্বারা
জানতে পারেন। অতএব বিজনে মন্ত্রণা করা উচিত’।
তারপর রাজা মন্ত্রী ছাড়া সবাই রাজসভা থেকে উঠে গেল। তখন চক্রবাক বলল, ‘প্রভু,
আমি জানতে পেরেছি আমাদের কোন অনুচরের প্রেরণাতেই বক এসব করেছে। শাস্ত্রেই তো আছে ঃ
রোগী বৈদ্যদের লাভজনক, বিপন্ন প্রভুরা মঙ্গলজনক, মূর্খরা বিদ্বানদের
জীবনস্বরূপ, কলহপ্রিয় প্রজারা রাজার জীবন’।
রাজা বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। কারণ নয়ত পরে স্থির কর। এখন কর্তব্য কি বল?’
চক্রবাক বলল, ‘তাহলে আপনি সেখানেও চর পাঠান। তখন আমরা জানতে পারব, ওই রাজা কি
চায়, তার শক্তি আর সামর্থ্যই বা কতটুকু। মহারাজ—
নিজের ও পরের রাজ্য সম্বন্ধে কি করণীয়, কি করণীয় নয় তা জানবার জন্য গুপ্তচরই
রাজার চক্ষুস্বরূপ। যার গুপ্তচর নেই তিনি অন্ধতুল্য—অর্থাৎ নিজের কর্তব্য সম্পাদনে
অক্ষম।
তাহলে মহারাজ সে আবার দ্বিতীয় আরেকজন বিশ্বাসভাজনকে নিয়ে তার সঙ্গে সেই রাজ্য
সম্বন্ধে মন্ত্রণা দিয়ে চলে যাক। কারণ কথায়ই তো আছে ঃ
শাস্ত্র আলোচনা করবার ছলে তীর্থস্থানে, তপোবনে ও দেবালয়ে তপস্বীবেশধারী
গুপ্তচরের কাছে পর রাজ্যের বিষয়ে জানবে।
মহারাজ, গুপ্তচররা জলে ও স্থলে বিচরণ করে। যা হোক এই বককেই তাহলে নিয়োগ করুন,
আর তার সঙ্গে যাক দ্বিতীয় আরেক বক। সেই অবসরে দূতের পরিবারকে রাজদ্বারে নিয়ে আসুন।
কেউ যেন না টের পায়। কারণ ঃ
নীতিবিদদের মত হল মন্ত্রণা প্রকাশ হয়ে গেলে যে বিপদ হয় রাজারাও তা দূর করতে
সমর্থ হন না’।
রাজা বলল, ‘তাহলে আমি ভাল দূত পেয়েছি বল?’
মন্ত্রী বলল, ‘তাহলে আমাদের যুদ্ধ জয়ের আর বাকি কি?’
এমন সময় দৌবারিক এসে বলল, ‘মহারাজ জম্বুদ্বীপ থেকে শুক এসেছেন’।
রাজা মন্ত্রীর দিকে তাকাতেই মন্ত্রী বলল, ‘ঠিক আছে, তাকে নিয়ে গিয়ে দূতগৃহে
রাখ। পরে দেখা হবে’।
দৌবারিক চলে গেলে রাজা বলল, ‘মন্ত্রী, তবে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল?’
‘না-না, মহারাজ’। মন্ত্রী বলল, হঠাৎ যুদ্ধকরা শাস্ত্রসম্মত নয়। পূর্বে আলোচনা
না করেই যে রাজাদের যুদ্ধদ্যোগ, রাজ্যত্যাগ বা পলায়ন করতে উপদেশ দেয় সে অনুপযু্ক্ত
অনুচর এবং মন্ত্রী যেখানে দেখা যায় যুযুধান দুই পক্ষের জয় অনিশ্চিত, সেখানে যুদ্ধে
শত্রুকে পরাভূত করার চেষ্টা কখনও করা উচিত নয়। যুগপৎ সাম, দান ও ভেদ দিয়ে অথবা
পৃথকভাবে শত্রু জয় করতে চেষ্টা করবে, কিন্তু যুদ্ধ দিয়ে কখনও নয়।
যুদ্ধে বর্তমান না থেকে সবাই নিজেকে বীর বলে মনে করে। শত্রুর সামর্থ্য না জেনে
কে না গর্বিত হয়? আর যন্ত্রণার কথা কি বলব মহারাজ—
যথাকালে হলকর্ষণ কর্মের চেষ্টা করলে যেমন কৃষিকার্যে সুফল পাওয়া যায়, হে রাজন।
তেমনি রাজনীতি বহুকাল পরে সিদ্ধ হয়, অল্পকালে ফল পাওয়া যায় না।
জ্ঞানী ব্যক্তির গুণ হল ভয়ের কারণ আসন্ন হলে পরাক্রম প্রদর্শন করা। স্থিতধী
পুরুষ বিপদ উপস্থিত হলে ধৈর্য অবলম্বন করেন।
কাল না হলে যে শত্রুজয়ের চেষ্টা করে সে মূর্খ। বলশালীর সঙ্গে যুদ্ধ পিঁপড়ের
পাখা ওঠার মত।
নির্লজ্জ ব্যক্তি কচ্ছপের মত নিশ্চেষ্ট থেকে শত্রুপীড়নও সহ্য করেন, কিন্তু সময়
এলে ক্রুদ্ধ ব্যক্তির মত প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করেন।
অতএব, মহারাজ, যে পর্যন্ত না আমাদের দুর্গ সজ্জিত হয় ততদিন পর্যন্ত শুককে
এখানে রেখে দিতে হবে। কারণ ঃ
দুর্গাশ্রয়বিহীন রাজা ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শত্রু কার না পরাভবস্থানীয় হয়?
দুর্গবিহীন ও আশ্রয়হীন রাজা সমুদ্রে পোতভ্রষ্ট মানুষের মত।
তবে দুর্গ তৈরিরও নিয়ম আছে।
বিস্তৃত, গভীর পরিখাবেষ্টিত, উচ্চপ্রাকার সংযুক্ত, যুদ্ধপযোগী অস্ত্রাদিসহ,
পানীয় জলযুক্ত, পর্বত, নদী, মরুস্থান, বনবেষ্টিত এরুপ স্থানেই দুর্গ নির্মাণ করা
উচিত।
দুর্গ নির্মাণ করলেই হয় না মহারাজ। তার মধ্যে কিছু জিনিসও রাখতে হবে। যেমন ঃ
বিস্তীর্ণ, অত্যন্ত উচু-নিচু, জলাশয়যুক্ত, ধানক্ষেতযুক্ত, মাঠ, প্রবেশ ও
বহির্গমন পথ এই সাতটি দুর্গের সম্পদ।
রাজা বলল, ‘দুর্গের স্থান নির্ণয় করবে কে?’
‘আজ্ঞে’। চক্রবাক বলল ঃ
যে যে কাজে দক্ষ তাকে সেই কাজেই নিয়োগ করা উচিত। যে যে কাজে অনভিজ্ঞ সে
বিদ্বান হলেও কার্যকালে সে কর্তব্যবিমূঢ় হয়’।
‘তাহলে সারসকে ডাক’। রাজা বলল।
খবর পেয়েই সারস এসে উপস্থিত।
রাজা বলল, ‘সারস, তুমি এক কাজ কর। একটা দুর্গ অনুসন্ধান কর তো’।
সারস বলল, ‘মহারাজ, এ তো ঠিকই আছে। এই সরোপরটাই তো দুর্গরূপে নির্দিষ্ট। শুধু
মধ্যদ্বীপে কিছু খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে। কারণ ঃ
হে রাজন ঃ সর্ব সঞ্চয়ের মধ্যে ধানই শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ। মুখে ধন প্রদান করলেও
প্রাণ রক্ষা করা যায় না।
আর সকল রসের সেরা লবণ। সেই লবণ সংগ্রহ করা উচিত। কারণ তা ছাড়া সকল ব্যঞ্জন
গোময়তুল্য বিস্বাদ’।
রাজা বলল, ‘তাহলে যাও, গিয়ে সব ঠিক কর’।
এমন সময় এক শাস্ত্রী এসে বলল, ‘মহারাজ, সিংহল দ্বীপ থেকে এক কাক এসেছে। সে
আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়’।
রাজা বলল, ‘কাক বুদ্ধিমান ও বহুদর্শী। তাহলে তাকে আমাদের পক্ষে নিযুক্ত করা
উচিত’।
চক্রবাক বলল, ‘মহারাজ, আমাদের বিরুদ্ধপক্ষ কাক স্থলচর। তাকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক
হবে? কারণ ঃ
যে আত্মপক্ষ পরিত্যাগ করে শত্রুপক্ষে অনুরক্ত থাকে সে মূর্খ নীলবর্ণ শৃগালের
মত শত্রু কর্তৃক নিহত হয়’।
রাজা বলল, ‘কি রকম?’
‘তাহলে শুনুন মহারাজ’। বলে মন্ত্রী বলতে লাগল ঃ
0 Reviews