Read more
নাবিক রাজপুত্র
এ গল্পের রাজাটি প্রথমেই মরে গেলেন। বাকি
রইলেন কে? রাজরাণী আর রাজার চার ছেলে।
চারজন রাজপুত্র চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু
তা হলে কি হবে? তিনছেলে বড়সড়ো—মার ধারই ধারে না—ছোটটি আছে কোল ঘেঁষে। রাণী তাই
পছন্দ করেন শুধু তাঁর ছোট্ট ছেলেটিকে।
ঘোড়াশালের ভালো ঘোড়াটি তার, সব চাইতে দামী
আর হাল্কা মসলিনের পোশাকের বাহার তার, সোনার থালাটিতে ভাত খাবে শুধু সে,
চন্দনকাঠের পালঙ্ক তার জন্য।
কাজেই বাকি বড়োরা ছোটর উপর গেল চটে। বললেঃ
‘মা, তুমি তোমার আদরের দুলাল নিয়ে অন্য বাড়ি চলে যাও—বাবার রাজপুরী আমরাই দেখব’।
মা বলেনঃ ‘তোদের মতো রাজা হবার শখ ওর নেই—তা-ই ভালো’।
মা-রাণী চলে এলেন ছোট খোকাবাবুকে নিয়ে আরেক
তরফে। খোকাবাবু সত্যি বেসামাল, এই হল মস্ত মুশকিল। মা-ও আগলে আগলে রাখতে পারেন না।
কখন কোথায় যাচ্ছে, কোন্ পেয়ারা গাছে চড়ে
সারাদিন কাঁচা-ডাঁশা পেয়ারা চিবুচ্ছে কে তার খোঁজ রাখবে। মা কি অত পারেন? শেষটায়
মা-ও আর নাগাল পান না তার।
একদিন কি হল শোনো ঃ
মা যাবেন গঙ্গাস্নানে—সঙ্গে যাবেন খোকাবাবু।
ঘাটে বাঁধা মস্ত এক পান্সী নৌকা। মাঝি-মাল্লারা কেউ নেই তখন-রাজপুরী দেখতে ডাঙায়
উঠে এসেছেন। নাগরদোলায় চড়বেন, মেলা থেকে পুতুল কিনে নিয়ে যাবেন ছেলেমেয়েদের জন্য—রাস্তায়
রাস্তায় ঘুরে দোকান-পাট দেখবেন—‘হাঁ’ করে রাজপুরী সিংহদরজার দিকে তাকিয়ে থাকবেন—দূরদেশের
নাইয়ারা তাই করতেন তখনও।
এমনি সময়ে মহারানী ছেলে নিয়ে ঘাটে এলেন
ধুমধাম লাগিয়ে। সাগর-পারের বেচারী মাঝী-মাল্লারা এ-সময়টাতেই গড়হাজির নৌকাতে।
এদিকে খোকাবাবুর তাতেই ফুর্তি। নৌকোর মালিক
নেই। তিনি দুমদাম করে নৌকোতে গিয়ে উঠলেন। মাকে ডাকলেনঃ ‘পান্সী চড়বে ত এসো মা’
মা বললেন ঃ ‘ছিঃ, নেমে আয় খোকা—পরদেশী
বেনিয়াদের নৌকোতে কেন উঠেছিস গিয়ে?’
খোকাবাবু বললেন ঃ ‘উহুঁ—কখখনো আর নামব না।
আমি সমুদ্র দেখতে যাব। এই ভাসিয়ে দিচ্ছি নৌকো – আসবে ত এসো’। নোঙর তুলতে শুরু
করলেন সত্যি খোকাবাবু।
মা আর কী করেন—সাত তাড়াতাড়ি গিয়ে নৌকোয়
উঠলেন। ততক্ষণে সওদাগরী মধুকর-ডিঙার নোঙর তুলে ফেলেছেন খোকাবাবু – আর অমনি বোঁ করে
সোঁতায় পড়ে চড়কির মতো ঘুরে উঠেছে ময়ূরপঙ্খি নাও। তারপর আর কি? রাজহাঁসের মতো ঢেউ
তালে গা ভাসিয়ে দে ছুট।
রানী তার রাজপুত্র সাগরে চললেন। যোজন-যোজন
মাইন নদীর জল পেরিয়ে পুরীর সমুদ্রের মতো এক সমুদ্রে গিয়ে পড়লেন তাঁরা। সেখানে পুরী
নেই—দ্বীপ। প্রবাল-দ্বীপ।
এখনকার কথা নয়।
অনেক আগের কথাও নয়। তারও ঢের আগেকার কথা।
প্রবাল কাকে বলে জানো ত? আংটিতে যে লাল-লাল
গোল পলা সাজানো থাকে তা-ই। সমুদ্রে লাল-লাল একরকম পোকার হাড় জমে। পাথরের মতো শক্ত
হয়ে যায় কিন্তু ভারী হয় না ততো। তা-ই জলের উপর ভেসে থাকে দ্বীপের মতো। তা-ই তুলে
নিয়ে আসে আজও। দামী জিনিস। আর সেদিন ত তার আরো কত দাম।
মুঠোভরা খানিকটা দ্বীপ সাতরাজার ধন মানিক।
ছোট কুমার গুনে গুনে বারোটি মস্ত প্রবাল তুলে নিলেন তাঁর নৌকায়।
মা কিন্তু খুশী হলেন না। বললেন ঃ ‘লাল
বলগুলো নৌকোয় তুলিসনে বাপু—হয়তো কোন্ সওদাগরের নৌরোডুবি হয়েছে—তাঁরই হয়ত ছিল এসব।
পরের ধন নিতে নেই। লোকে চোর ভাববে আমাদের’।
‘সে কি, প্রবাল কুড়িয়ে নিলে চোর বলবে কেন?’
‘কার প্রবাল তুই জানিস না কি? ফেলে দে’—মা-ও
জেদ ধরলেন।
ফেলে দিতেই হল। সবই ফেলে দিতেন কুমার কিন্তু
লোভ হল। একটি লুকিয়ে বেঁধে নিলেন উড়নিতে।
উজান
হাওয়া লেগেছিল ডিঙিতে। তীরে ভিড়ল হেলেদুলে ময়ূরপঙ্খি নৌকো। রানী আর রাজপুত্র একটা
মস্ত বন্দরের ঘাটে গিয়ে উঠলেন।
0 Reviews