রাজকন্যা অরণ্যে এসেছিলেন বসন্তের ফুল তুলতে সখীদের সঙ্গে।

রাজকন্যা অরণ্যে এসেছিলেন বসন্তের ফুল তুলতে সখীদের সঙ্গে।

Author:
Price:

Read more

রাজকন্যা অরণ্যে এসেছিলেন বসন্তের ফুল তুলতে সখীদের সঙ্গে। সাতরঙা হ্রদের জলে নেমে হাত বাড়িয়ে যেই লাল পদ্মফুল তুলতে গেছেন, জলদৈত্য এসে তাঁকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেল জলের তলায় পাতালপুরীতে।
ব্যাঙ্গমা ফিস্‌ করে বলে –হ্যাঁ। ঐ হ্রদের জলের তলায় পাতালপুরীতে যাওয়া যেতে পারে একমাত্র ফণীর মণির আশ্চর্য আলোয়। লক্ষঝুরি যদি তপস্যায় তুষ্ট হয়ে কালনাগকে তার মাথার মণি মাটিতে ফেলে দেওয়ার আদেশ দেন-তা’হলে রাজপুত্তুর হারানো ছোটবোন পেলেও পেতে পারেন।
আকাশ সাদা হয়ে ভোর হয়ে এলো বাসা ছেড়ে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী উড়ে চললো উত্তর সাগরের মুখে।
লক্ষঝুরির সাতশো মহল প্রাসাদের এক কোণে বাস করতো দুগ্‌গো টুনটুনি পাখী। এর কথা ওর কাছে, ওর বার্তা তার কাছে টুন্‌-টুন্‌ করে লাগানোই ছিল তার কাজ আর আনন্দ। সে রাত্রিবেলায় সম্তর্পণে কান পেতে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর সমস্ত কথা শুনে নিয়েছিল। ভোর হতে না হতে গুগগো টুনটুনি উড়ে চললো কুঠো ঠোঁটে ধরে-সেই ধবল পাহাড়ের দিকে, যেখানে বিজন দেশের রাজপুত্তুর বামহাতে হীরামুখী বর্শা আর ডানহাতে সোনার তরোয়াল নিয়ে খুঁজে ফিরছেন হারানো রাজকন্যাকে।
উড়ে-উড়ে-উড়ে-উড়ে-উড়ে কত মাঠ-কত নদী পার হয়ে দুগ্‌গো টুনটুনি এসে পৌঁছালো ধবল পাহাড়ের শিখরে।
ধবল পাহাড়-ধবল পাহাড় শুধু তুষারের রাশি-বরফের স্তুপ। সবুজের লেখ নেই-রঙের রেশ নেই। ঝরণাগুলি ঝরছে গলানো তুষার ধারায়-ঠিক যেন হিমেল দুধের ধারা। রাজপুত্তুর তখন শিখর পার হয়ে নেমে চলেছেন অন্য রাজ্যে-আরেক রাজার দেশে। নীল ঘোড়ার ক্ষুরে-সোনার নালে-তুষারের রাশি খোলায় খৈ-ভাজার মতই ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঠেছে।
দুগ্‌গো টুনটুনি উড়ে এসে বসলো রাজপুত্তুরের কাঁধে। রাজপুত্তুর চমকে তরবারি খুললেন।
দুগ্‌গো-টুনটুনি রাজপুত্তুরের কানের মধ্যে মুখ দিয়ে বলে উঠলো ভয় পেয়ো না। আমার নাম দুর্গা। একের খবর অন্যের কাছে পৌঁছে দিই বলে সবাই নাম দিয়েছে টুনটুনি। সকলেই আমাকে ডাকে দুর্গা টুনটুনি—রাগ হলে লোকে গাল দেয় দুর্ঘটন টুনি।
রাজপুত্তুর রাগ করে বললেন—‘তা এখানে আমার কাঁধে চড়ে বসেছ কোন্‌ দুর্ঘটন ঘটাতে শুনি?
টুনি বললে—আমার নাম তুমি যদি শুভ টুনটুনি করে দাও, তা হলে তোমার হারানো বোনকে পাইয়ে দিতে পারি।
রাজকুমার ব্যগ্র হয়ে বললেন-এমন সুঘটন যদি ঘটাতে পারো, তোমার নাম দেবো আমি-সোনার টুনটুনি।
টুনি হেসে তখন টুন্‌ টুন্‌ টুন্‌ টুন্‌ করে রাজপুত্তুরের কানে কানে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর সমস্ত গল্পটি বললো।
রাজপুত্তুর বললে-এখনি যাবো আমি তোমার সঙ্গে তোমাদের অরণ্যের অধিপতিকে তপস্যায় তুষ্ট করতে। তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো।
টুন্‌ টুনি রাজপুত্তুরকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এল নিজেদের অরণ্যে। রাজপুত্তুর লক্ষঝুরির তলায় দাঁড়িয়ে নিজের চারিধারে অগ্নিকুন্ড জ্বেলে ঊর্দ্ধ আকাশে তাকিয়ে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। আহার নেই, শয়ন নেই, ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। ঠায় একভাবে দাঁড়িয়ে তিনদিন তিনরাত্রি স্থলে ছয়দিন ছয়রাত্রি কেটে গেল। সাতদিনের দিন সন্ধ্যাবেলা লক্ষঝুরি মহাবট সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর প্রজা কালফণীকে আদেশ দিলেন, তাঁর মাথার মণিকে ফেলে দিতে। কালফণী মাটিতে মাণিক ফেলতেই রাজপুত্তুরের চারিপাশে জ্বলন্ত অগ্নি নিবে গিয়ে তার বদলে রাশি রাশি সুরভি ফুল ফুটে উঠলো। সারা অরণ্য জ্যোৎস্নার চেয়েও শীতল স্নিগ্ধ উজ্জ্বল এক আশ্চর্য আলোয় হেসে উঠলো।
মাণিক কুড়িয়ে নিয়ে রাজপুত্র ছুটে চললেন সাতরঙা হ্রদের পানে।
মাণিকের আলোয় অরণ্যের কাঁটাবন ঘনবন ফাঁক হয়ে গিয়ে সুন্দর পথ আপনা-আপনি জেগে উঠতে লাগলো। হ্রদের ধারে পৌঁছে রাজপুত্র দেখতে পেলেন, জলের মাঝে শত-শত পদ্মফুল ফুটে আছে মাণিকের আলোয় সেই পদ্মফুলগুলি অনেকগুণ বেশী প্রকান্ড  দেখাতে লাগলো। রাজপুত্র অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখলেন, সেই সব পদ্মের বুকের ভিতর দিয়ে থরে থরে সরু সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে—ধাপের পর ধাপে।
রাজপুত্র হাতের মুঠোয় মণি চেপে হ্রদের জলে ঝাঁপ দিলেন। সাঁতার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটি প্রকান্ড পদ্মফুলের উপর উঠে দেখলেন মৃণালের মধ্যে দিয়ে পাতালপুরীর তলায় দিব্যি সরু সিঁড়ি। মণি হাতে রাজপুত্র সেই সিঁড়ি বেয়ে তর্‌তর্‌ করে নেমে চলে গেলেন পাতালপুরীর মধ্যে।
সেখানে গিয়ে দেখতে পেলেন, স্ফটিকেরই ঘরে স্ফটিকের খাটে স্ফটিকের বালিশ মাথায় দিয়ে তাঁর হারানো ছোটবোনটি গালে হাত রেখে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। তার চোখের অশ্রু বিন্দুগুলি স্ফটিকেরই মালার মতন দেখাচ্ছে।

জল-দৈত্যকে হীরামুখী বর্শায় বিঁধে বধ করে-রাজকুমারীকে উদ্ধার করে বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজপুত্রের যে বেশী সময় লাগেনি, তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করে নিতে পারবে। তাই এইখানেই আমার কথাটি ফুরালো।

0 Reviews