Read more
অরণ্যের অধিপতি
গভীর অরণ্য।
অরণ্যের ঠিক মাঝে-মধ্যিখানে হাজার হাজার বছরের পুরোনো বিরাট বটবৃক্ষ—লক্ষঝুরি। একা
লক্ষঝুরিই একটা অরণ্য যেন। তার ডালে ডালে শাখায় শাখায় হাজার-হাজার পাখ-পাখালির
বাসা-কোটি কোটি কীট পতঙ্গের গর্ভ। তা’ ছাড়া তার মোটা-মোটা ঝুরির অরণ্যে ঝুপসি
আঁধারে বাস করে ক-ত জন্তুজানোয়ার। বাঘ-ভাল্লুক-নেকড়ে-বরা থেকে-খরগোস বেঁজী বনবিড়াল
পর্যন্ত।
লক্ষঝুরিকে
মেনে চলে সারা অরণ্য। সমস্ত বৃক্ষ তরুলতা গুল্ম জীব-জন্তু পশু-পক্ষী
কীট-পতঙ্গ-সকলেই। লক্ষঝুরি ক্রুদ্ধ হলে আর রক্ষে নেই। একবার রেগে মাথা ঝাঁকুনি
দিলে সারা অরণ্যের প্রলয় উপস্থিত হয়ে যায়।
লক্ষঝুরির
মাথা থেকে নেমে আসা ঝুরিগুলিই এখন এক একটা বিপুল বনস্পতির মত। তাদেরও কোটরে-কোটরে
অজগর সর্প-কালফণী-পাতায় পাতায় নানা পক্ষী-অঙ্গে অঙ্গে শতশত কাঠবিড়ালীর ওঠা-নামা
ছুটোছুটির বিরাম নেই সমস্ত দিন।
এ-ই
লক্ষঝুরির সবার চেয়ে—উুঁচু শীর্ষে শিখরে—আগডালের মগ আগায় সোনালী খড়ে রূপলী ঘাসে
সুন্দর বিনুনী করা বাসা বেঁধে বাস করতো এক ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী।
ঘন অন্ধকারের
কালো চাদর মুড়ি দেওয়া এক গভীর নিশুতি রাত্রি।
চারিদিক
স্তব্ধতার ভারী পাথর চাপা পড়ে নিথর-নিস্পন্দ। চাঁদহীন শোকাচ্ছন্ন আকাশে লক্ষ লক্ষ
নক্ষত্র শুধু ঝিম্ ঝিম্ করছে। জ্যোৎস্নাহারা গভীর অরণ্যে রাশি রাশি অন্ধকার গাঢ়
হতে গাঢ়তর হয়ে জমেছে। লক্ষঝুরির বিরাট প্রাসাদের চুপি চুপি বিরাট প্রাসাদের
মহলে-মহলে একতলায় দোতলায় তেতলায় চারতলায় কেবলি ফিস্-ফিস্ শব্দে বাতাসের চুপি
চুপি যন্ত্রণা পরামর্শ চলেছে সারা রাত ভরে।
ব্যাঙ্গমা
বলে – ব্যাঙ্গমী। জেগে না ঘুমিয়ে?
ব্যাঙ্গমী
জবাব দেয়—আধ-ঘুমে-আধ-জাগায়। --তুমি?
ব্যাঙ্গমা
বলে – আমিও তাই। তার চেয়ে আয় গল্প করি।
ব্যাঙ্গমী
বলে বেশ তো।
ব্যাঙ্গমা
বলে – ব্যাঙ্গমী। সেই যে বিজন দেশের রাজপুত্তুর ডান-হাতে সোনার তরোয়াল, বাম-হাতে
হীরেমুখী বর্শা—নীল-রঙের পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে—তার হারনো ছোটবোনটিকে খুঁজতে
বেরিয়েছিল-মনে আছে তোর?
ব্যাঙ্গমী
বলে – মনে আবার নেই? এমনি আজকের মতনই এক নিবিড় অমাবস্যার নিঝ্ঝুম রাতে রাজপুত্তুর
এসে নীল ঘোড়া বেঁধেছিলেন না আমাদেরই এই লক্ষঝুরি মহাবটের প্রাসাদ তলায়? সেই রাত্রে
রাজপুত্তুর আমাদের এই বৃক্ষ-প্রাসাদের দোতালার মহলে শুয়ে রাত কাটিয়ে গিয়েছিলেন।
ব্যাঙ্গমা
বলে – ঠিক। কিন্তু জানিস্ কি সে-বেচারা আজও দেশ-দেশান্তরে অরণ্যে-প্রান্তরে
সাগরে-পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছে হারানো বোনের খোঁজে?
ব্যাঙ্গমী
গম্বীর স্বরে বলে জানি।
ব্যাঙ্গমা
বলে-আরও কিছু জানিস কি?
ব্যাঙ্গমী
জবাব দেয়- জানি বৈকি?
ব্যাঙ্গমা
রাগ করে বলে-জানিস্ তো বল দিকি।
ব্যাঙ্গমী
বলে—জানি তার সে হারানো ছোটবোন কোথায় আছে।
ব্যাঙ্গমা
বলে আমি তোর চেয়ে বেশি জানি।
ব্যাঙ্গমী
বলে শুনি।
ব্যাঙ্গমা
চুপিচুপি বলে-আমি জানি কোন্ উপায়ে রাজপুত্তুর হারানো রাজকন্যাকে খুঁজে পেতে
পারেন।
ব্যাঙ্গমী
বলে বলো না শুনব।
ব্যাঙ্গমা
বলে দেশ-দেশান্তর, সহর-গ্রাম, বন-মরুভুমি, সমুদ্র-পর্বত ছুটে ছুটে কিছুই হবে না।
এই মহা-অরণ্যের অধিপতি আমাদের লক্ষঝুরির তলায় তিনদিন তিনরাত্রি খাড়া দাঁড়িয়ে
উর্ধ্ব-আকাশে চক্ষু মেলে তপস্যা করে লক্ষঝুরিকে প্রসন্ন করতে পারলে, লক্ষঝুরি তাঁর
বিরাট কোটরের অধিবাসী সাতশো বছরের কালনাগকে হুকুম দেবেন তার মাথার মণি মাটিতে
ফেলতে। সেই মণি নিয়ে যাত্রা করলে তবে হারানো রাজকন্যাকে খুঁজে পাবে।
ব্যাঙ্গমী
আস্তে-আস্তে স্বর নীচু করে বলে তাতো বটেই। রাজকন্যাকে তো জল-দৈত্য চুরি করে লুকিয়ে
রেখেছে এই মহা-অরণ্যেরই সাতরঙা হ্রদের জলের তলায়। সে হ্রদের জল সকালবেলায় থাকে নীল
সোনালী রং, দুপুরবেলায় হয় রূপোর রং আর ইস্পাতের রং, বিকেলবেলায় ময়ূরকণ্ঠী আর
সন্ধ্যাবেলায় হয় আবীর-কুমকুম গোলা। রাত্রির আঁধারে কিন্তু সেই জলই হয়ে ওঠে কালির
মত কালো, নিকষ-নিতল।
0 Reviews