Read more
আর খোকা-মহারাজ ত সেদিনকারই ছেলে—সে জানত
মাকে কোন্ কথা বলে বিদায় নিতে হয়। খুশী হয়ে মা ছেড়ে দেন কোন্ কথা শুনলে তা
অবশ্যি তোমরাও জানো সবাই।
সওদাগরী নৌকা সাজল—পাল খাটান হল। বকের বুকের
মতো চিকানো সাদা পাল। মকরের মুখ নৌকোর গলুই-এ। রাজহাঁসের ভঙ্গি দেহটায়। মৌমাছির
হলুদ রঙের ডুরি কাটা তাতে। মাঝে-মাঝে ভোমরার গায়ের কালো রঙের দাগ। ঠিক যেন সোঁদরবনের
বাঘ। কিন্তু নাম তার সপ্তডিঙা-মধুকর।
যাবার সময় উপস্থিত হলে মাকে প্রণাম করল
খোকা। রাজা রাজ্যের ওস্তাদ মাঝি-মাল্লাদের নৌকায় তুলে দিয়ে বললেন ঃ ‘ইনি তোমাদের
প্রথম কাপ্তান। এঁর আদেশ মাথায় তুলে নেবে’।
পুরোপুরি একটি দিন ডিঙা দাঁড় টানল নুলিয়া
নেয়েরা। দেখালো, যে একটি দাঁড়কাক ভেসে চলেছে দোদুল-দোল নীল সায়রের বুকে। তাঁদের
দাড়ি ভিজে উঠল ঘামে। টুকটুকে আমাদের ডালিম কুমারের মুখ রোদের আভায় দুনো সুন্দর হল।
দক্ষিনী নেয়েরা বলাবলি করলেন—সূয্যিঠাকুর নেমে এসেছেন এ নায়ে।
সূয্যি ঠাকুর কিন্তু ভাবছিলেন এবার অন্যকথা।
ঘুর্ণি সোঁতা প্রবাল ফোয়ারার কাছে যতোই এগোচ্ছে কুমার ততোই ভাবছে এবার ডুব দেবে
সাগর জলে। তলিয়ে যাবে সাগর-তলে। কোথায় তৈরী হচ্ছে প্রবাল—তাই দেখবে। -ডুবুরীর
পোশাক সঙ্গে নেই। কাপড়টা মালকোঁচা এঁটে
তৈরী হল রাজপুত্র।
ঘুর্ণিজলে পড়ে পাক-খাওয়া ঘুড়ির মতো ঘায়েল
হচ্ছিল যখন ডিঙা। নেয়েরা সবাই ব্যস্ত নৌকোর জান বাঁচাতে—তখন টুপ করে দে ডুব
পাতালে। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল কাপ্তান। নুলিয়ার বাচ্চাদল ত গেল গেল বলে চেঁচিয়ে উঠল,
কিন্তু গলুই-এ দাঁড় ধরে যে ধাড়ী নুলিয়া বসে ছিলেন, তিনি বললেন ঃ ‘অত চেঁচাচ্ছিস্
কেন রে—অ্যাঁ? দেখছিসনে ও রাজপুত্তুর প্রবাল দ্বীপের খোঁজ জানা রাজার ছেলে। ডিভি
সালে রাখ্ উঠে এলেন বলে’।
সত্যি তা-ই। রাজপুত্র পাতালে তলিয়ে মস্ত এক
প্রাসাদ দেখতে পেল। অদ্ভুত এক রাত্রির রাজ্য। কী আশ্চর্য সব ঝাউ-চারা আর তার
ফাঁকে-ফাঁকে তারামাছ জোনাকির মতো জ্বলছে। তোরণে কিন্তু কেউ নেই—মরামানুষ ভূতপ্রেত
কিচ্ছু না—তবু কে যে মানুষের হাতে গড়ে তুলেছিল এ-পুরী প্রবাল দ্বীপে—ভেবে অবাক হয়ে
গেল কুমার। অবাক হয়েই ভেতরে ঢুকল।
মধ্যের কামরায় এ কী। দেখে শীত-লাগা ভয়ে
দু’পা পেছিয়ে এলো কুমার। ঠিক তার বাবার মুখ নিয়ে এক শিব-মুর্তি। বুদ্ধের মুর্তির
মতো আসনে বসে আছেন। তাঁর মাথার উপরে উঠছে পেছন দিক থেকে একটি দোল-মঞ্চ। মঞ্চের
উপরে শুয়ে আছে এক কিশোরী—তারই বয়সী।
এমনটা হঠাৎ দেখলে কার না ঊয় হয়? তাই ভয় পেল
কুমার। কিন্তু পরের মিনিটেই ভয় উধাও। মঞ্চ বেয়ে উপরে গিয়ে উঠল সে। সেখানে এ আবার
কী?
কিশোরীর গলাটা দেহ থেকে আলগা। কে যেন
এইমাত্র কেটে গেছে। ‘কে এমন খুনে ডাকাত গো’—গা শিরশির ভয়ে ভাবল কি কুমার? না, তেমন
কিছু ভাবলে না সে। মন দিয়ে সে দেখতে শুরু করল পাতালপুরীর ব্যাপারখানা। কাটা
মুণ্ডুটি থেকে রক্তের লাল ধারা নালের মতো গড়িয়ে পড়ছে শিবের জটায় টুপটুপ। পড়েই তা
টুক্টুকে প্রবাল হয়ে যাচ্ছে। প্রবালের বিনি সুতো মালা সাগরের জলে ভেসে গিয়ে
ঘুর্ণিসোঁতার নীচে ঘুরপাক খাচ্ছে আর ঠেলে উপরে উঠে যাচ্ছে। এ ভাবেই তৈরী হচ্ছে
তাদের খেলার বল প্রবাল—আর রাজকন্যেও সুন্দরী হতে চান এ-প্রবালই চুলে গুঁজে।
ভাবতে ভাবতে খারাপ লাগতে শুরু করল কুমারের।
তখন গা-ছমছম করতে লাগল একটু একটু। চারদিকে তাকিয়ে দেখল, কেউ সত্যি কোথাও লুকিয়ে
আছে কি না তার গলায় কোপ বসাবার জন্য। কিন্তু জনপ্রাণীর কোন সাড়াশব্দ শুনতে পেল না
কুমার।
আর তখুন সে দেখতে পেল মেয়ের শিয়রে জীয়ন-কাঠি
আর মরণ-কাঠি। জীয়ন-কাঠি সোনার আর মরণ-কাঠি রুপোর। জীয়ন-কাঠি যদি কেউ ছোঁয়াত মেয়েটির
মাথায়, ওমনি কিন্তু সে বেঁচে উঠত। কিন্তু কে জানে সেই খবর? কুমার তো জানত না।
সোনার কাঠি বলেই হাত বাড়িয়ে ওটাকে তুলে নেবে
ভাবছিল কুমার তার হাত বাড়িয়ে ওটা তুলেও নিচ্ছিল। এমনি সময় হল কি...
পড়বি ত তুই পড় রে
বজ্র কড়াকড়রে
বাঁচুক যারা মরা
প্রাণেতে প্রাণ জোড়া
0 Reviews