ধুপ করে পড়ল কাঠি হাত ফসকে মেয়ের কাটা মুণ্ডুতে।

ধুপ করে পড়ল কাঠি হাত ফসকে মেয়ের কাটা মুণ্ডুতে।

Author:
Price:

Read more

ধুপ করে পড়ল কাঠি হাত ফসকে মেয়ের কাটা মুণ্ডুতে। অমনি তা লাফিয়ে গিয়ে ধড়ে জোড়া লাগল। মেয়ের দেহে প্রাণ এলো—মরা বেঁচে উঠল। পাতালপুরীর কী গুণ দ্যাখো।
ধড়ফড় করে উঠে বসল মেয়ে—তাকাল অপলক কুমারের মুখে। পাতালপুরীতে মানুষ। কোনো মানুষ কি আসে—আসতে পারে এখানে? অবাক হয়ে বললে মেয়ে ঃ ‘তুমি কে? কিভাবে এলে এখানে?’
এক এক করে সব কথা, জাহাজ-চুরি থেকে প্রবাল নেওয়া পর্যন্ত সব ঘটনা, কুমার শোনাল সে মেয়েকে।
শুনে ত মেয়ের আবার মুর্ছা যাবার যোগাড়। দম-আটকা গলায় বললে ঃ ‘দুঃখী ছেলে, শীগ্‌গির চলে যাও—মায়ের কোলে। দেখছ না শিব তপস্যায় বসেছেন, যখন জেগে উঠবেন, তোময় দেখতে পেলে ভস্ম করে ফেলবেন’।
মরণ ঢুকল এবার কুমারের মাথায়। বললে ‘একা আমি কি করে যাব—তুমিও চলো সঙ্গে’।
আমি? আমি ত যেতে পারিনে আমার দেবতাকে একা ফেলে’। মেয়েটির মুখ শুকনো দেখাল।
‘আমিও আমার দেবতাকে ছেড়ে একটি পা নড়ব না’।
‘তোমার দেবতা? কে তিনি?’
‘ঐ যে—শিব হয়ে আছেন যিনি—আমার মার যিনি দেবতা—আমারও’।
‘আমার যিনি দেবতা তোমাদেরও দেবতা তিনি?’ খুশী-খুশী দেখাল মেয়েটির মুখ।
‘দেখতে পাচ্ছ না আমার বাবা যে তিনি—বাবা—মহারাজ’।
মেয়েটি আহ্লাদে নেচে উঠে হাত ধরে ফেলল কুমারের। কী অদ্ভুত কথা বলছে রাজপুত্তুর।
‘জেগে উঠে তাকালেও বা কি’ মেয়েটির মেঘরবণ চুলে আদরের আঙুলে বিলি কেটে তখন বললে কুমার ‘বাবা বলবেন, যাও তোমরা যাও তোমরা উপরে উঠে’।
‘সত্যি বলবেন?’ মেয়েটি আদরে গলে গেল।
‘না-ই যদি বলবেন তা হলে আমি এ-পুরীর পথ চিনে কি করে এলাম। তিনিই ত আনলেন আমায় তোমাকে বাঁচাতে’। কুমারের চোখ ছলছল করে উঠল কান্না জমে। তারপরও কাঁদকাঁদ গলায় বললে সে ঃ ‘কিন্তু তিনি আর থাকবেন না কোনোদিন আমাদের সঙ্গে আগেকার মতো’।
কথার সঙ্গে সঙ্গে ওরা দেখতে পেলে শিবের মুর্তি পাথরের মুর্তি হয়ে গেছে।
দুজনেই ওরা শিবের পায়ে গড় করে উপরে উঠে এলো। প্রবাল ত সঙ্গে সঙ্গেই এলো দেদার। মাঝিরা তা তুলে নিলে মধুকর নায়ে। পাতালের মেয়েকেও কোলপাতালি করে নৌকোয় উঠিয়ে নিল সবাই। পালে হাওয়া  বুক ফুলিয়ে দিল। নুলিয়া নেয়েরা হাঁকলে ঃ ‘ঠাকরুন—ঠাকরুন’। বদর-বদর নাম ভুলে গেল তারা। আগে সে নামেই নৌকো ছাড়া হত, এখন দেখতে পেলে, সমুদ্র থেকে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী উঠে এলেন। লক্ষ্মীঠাকরুন।
হাজার হাজার চাঁদের সোনার টুকরো ঝিলকে উঠছে তখন সমুদ্রের জলে। শুক্লা চতুর্দশী—সন্ধ্যে থেকেই চাঁদের হাসি শুরু। চিল্কা-হ্রদের রাজার পুরী অনেক দূর—রাত্রীর উপছে পড়া জোয়ার সমুদ্রে—তবু ভয় কি আর। তাছাড়া স্বয়ং লক্ষ্মী যে নায়ের সওয়ারী তার আবার ভয় থাকে নাকি। লক্ষ্মীর কালো চুলের গুচ্ছ নিয়ে জ্যোৎস্নাতে আর হাওয়াতে যেন যুক্তি করে সাপ বানিয়ে দিচ্ছে। মধুকরে পাল ফুলছে—সাপ দুলছে। রাজপুত্তুর লক্ষ্মীমন্ত হয়ে চললেন মায়ের কোলে।
মা, মা সেই সকাল থেকে ঠায় বারো ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছেন বালুর উপর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। কখন সিন্ধুঘোটকের সওয়ার তাংর ছেলে ফিরে আসবে সেই সময়টিকে আকাশ জলে মেশা ধু-ধু দিগন্তে খুঁজে চলেছে তাঁর চোখ। প্রথম একটি চিলের মতো কালো তিল ফুটে উঠবে ধু-ধু সাদায়—ভোমরা, মধুকর ডিঙা আসছে তিনি বুঝবেন। ফিরে আসছেন তাঁর শিব শ্রীমন্ত বাণিজ্য করে। ভীরু হলেও স্বামীকে তিনি বারবারই ত বিদায় দিয়েছেন সমুদ্রে যাবার সময়ে। নৌকো-বোঝাই ধনদৌলত এনে দিয়েছেন স্বামী তাঁর হাতে। ষাট বছরের জীবনে অন্তত ষোলবার ত এমন হয়েছে, সতেরো বারের বার আর তিনি ফিরে এলেন না—মোহনায় এসেও ঘরে এলেন না—নৌকোডুবি হল। সঙ্গীরা এসে খবর দিলে রাজা নেই।

আজ বারবার সে-কথা, সেদিনের কথা মনে পড়তে চাইছিল কিন্তু মা তাদের ঠেলে দূরে সরিয়ে রাখছিলেন। খোকা আসবে—ফিরে আসবে—এই তো এলো বুঝি—এমনি সব আশার কথায় মন ভরে নিয়ে তিনি চুপচাপ বালিয়াড়িতে বসে ছিলেন।

0 Reviews