Read more
সাদা টিয়ের লাল ঠোঁট বুঝি ঠুকরে দিল মুখটা।
মুক্তোর বরণ হাজকন্যে বিরস মুখে গোসা ঘরে গিয়ে ঢুকলো। দাঁতে কুটোটিও কাটবে না যদি
আরেকটি প্রবাল না পায়। উপবাস করে ঠায় পড়ে থাকবে থাকবে রাগে মুখ গুঁজে। রাগী ছিল কি
না রাজকন্যারা তাই রাজারা বুদ্ধি খাটিয়ে তখন মেয়েদের রাগের পালা ভাঙবার জন্য একটা
ঘর তৈরী করে রাখতেন। তা-ই গোসা-ঘর। কন্যা গোসা-ঘরে গেল। তার রাগ ভাঙানো-ও ছিল খুব
শক্ত ব্যাপার।
সাধাসাধি করতে হত বিস্তর তবে কন্যে রা
কাড়তেন, নইলে মরার মতো চুপ।
বিরাট রাজ, মাথায় পাগ, পাগে পালক, সোনার
ঝালর—ঝিলমিল করে তোলেন আলোয়, ভরে তোলেন দশদিক—তিনি কি কন্যার মনের কালো ব্যাথাটুকু
মুছতে পারেন না? নিশ্চয়ই পারেন। পাগের আলো হেলিয়ে দুলিয়ে গোসা ঘরে এসে ঢুকলেন
তিনি।
কন্যা ত এই জন্যেই চুপটি মেরে ছিল—বাবা কখন
আসেন—এক-দুই করে সময় গুনছিল, যদি হাজার গুনবার আগে না আসেন, তবে আর এ-প্রাণ রাখবে
না, ভাবছিল। হাজার কেন শ’ও গুনতে হল না—রাজা এসে হাজির। বললেনঃ ‘কি রে, কি হলো
আবার?’
আদরের দুলালীর বোঁজা চোখে পলক পড়ল। চোখ মেলে
তাকালো মেয়ে।
‘আরেকটি প্রবাল চাই আমার, ঠিক এরকম—দাও ত
বাঁচব, নইলে এই ঘরেই আমার প্রাণ যাবে’।
কি রকম সাংঘাতিক আব্দার দ্যাখো।
রাজা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ধরো-পাকড়ো রব উঠল
রাজপুরীতে। খোঁজো সব রাজার ভাণ্ডার—কে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে কতো রকম প্রবাল-মণি
নিয়ে এসো খুঁজে—দেখাও রাজকন্যাকে। হৈ-হৈ পড়ে গেল চারদিকে। প্রবাল-রত্ন চাই।
কিন্তু প্রবাল নাবিক ছাড়া প্রবালের খবর কে
রাখে? বাংলার রাজপুত্র ছাড়া সেদিনে প্রবল নাবিকও বা কে ছিলেন?
বিকেল পড়তেই কথাটা মনে পড়ল রাজার—ছেলেরা তখন
ময়দানে যাচ্ছিল খেলবার জন্যে—দেখেই মনে পড়ল। আমাদের কুমারের তলব পড়ল এবারে আবার।
প্রবালের জন্য ডেকেছেন রাজ—শুনে ত রানী
মুর্ছাই যাচ্ছিলেন। পাইক-বরকন্দাজ বললে ঃ ‘না না যা ভাবছেন তা নয়—মহারাজ আরেকটি
প্রবাল চাইছেন ওটার জুড়ি। যদি ধরে থাকে দিয়ে দিন’।
শুনে মার চোখ শুকোলো কিন্তু গলা শুকিয়ে কাছ
হয়ে গেল ভাবনায়। খোকা ত আবার ছুটবে সমুদ্রে।
মার ভাবনা কি বিফল হয়? তা-ই হল। রাজপুরী
থেকে খোকা ফিরে এসে বললে ঃ’এই নাও মা ধনদৌলত—আমি সমুদ্রে যাচ্ছি রাজার জন্যে
প্রবাল আনতে। ঈস্ দ্যাখোত, তখনই ত কতো আনতে পারতাম—তুমি বললে ফেলে দিতে’।
‘কাজ নেই খোকা ধনদৌলতের—ওসব তুই ফিরিয়ে দিয়ে
আয়—চল্ আমরা পালাই’। মা বললেন।
‘তুমি বড্ড ভীতু মা’ ছেলে বললে।
‘তোর লোভ বাড়ছে বলেই আমার ভয়’। মা খোকাকে
বুকে টেনে নিলেন, কিছুতেই যেতে দেবেন না।
মাক কোলে মিশে গিয়ে খোকা বললে ঃ ‘লোভে পড়ে
কি আমি সমুদ্রে যাচ্ছি মা? দেখাতে যাচ্ছি যে কাজ আর কেউ পারে না তা বাংলার ছেলে
করতে পারে—তোমার ছেলে হেসে খেলে তা করে দেয়’।
মা ছেলের মুখে মরা মহারাজের মুখ দেখতে পেলেন—যিনি
আজ তাঁর মনে শিব হয়ে আছেন—স্থির একটি মুখ ঠাকুর-দেবতার মতো।
মনে-মনে সে-দেবতাকেই নমস্কার জানালেন মা—চুমু
খেলেন ছেলের মুখে—কাজল লতা থেকে কড়ে আঙুলে কাজল তুলে ছেলের কপালে টিপ আঁকলেন।
সমুদ্রের বরুণ-দেবতা এ-টিপ ভালবাসেন, মা তা জানেন। কোনো অমঙ্গল হবে না ছেলের এ-টিপ
কপালে থাকলে। তাছাড়া দীপ ভাসিয়ে দেবেন তিনি সমুদ্রের জলে ডিঙা-মধুকর ভাসবার সঙ্গে
সঙ্গে—বরুণ দেবতা খুশী হবেন দীপ-দানে।
দীপালীতে যে আমরা দীপ জ্বালাই, তুলসী-তলায়
দীপ দিই, ঠাকুর ঘরে যে দীপ ছাড়া চলে না—আকাশে দীপ তুলে ধরি শীত পড়িপড়ি সময়টাতে, সব
তা কালাপানির দেবতা বরুণের জন্যে, তা জানো তো? বাঙালী যেদিন সওদাগর জাতি ছিলেন,
সেদিনকার পুজো এই দীপ জ্বালানো। এখনো আমরা ভুলিনি সে কথা।
0 Reviews